‘মুহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে রসায়ন বিভাগের অতি নিরীহ একজন ছাত্র বাস করতো। এসএসসি ও এইচএসসিতে তার রেজাল্ট ভালো ছিল বলে তাকে একটি সিঙ্গেল সিটের রুম দেয়া হয়েছিল। গোবেচারা এই ছাত্রের নাম হুমায়ূন আহমেদ।’
‘ঊনসত্তর আমার পছন্দের একটি বছর। আমার লেখালেখি জীবনের শুরু এই ঊনসত্তরে। একটি মহান আন্দোলনকে কাছ থেকে দেখা হয় এই ঊনসত্তরেই। মানুষ চন্দ্র জয় করে ঊনসত্তরে।’ ‘আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র। থাকি মুহসীন হলে’। - হুমায়ূন আহমেদ, মাতাল হাওয়া
১৯৬৯।
সময় তখন উত্তাল। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর বাঙালি। আন্দোলন-সংগ্রামের বছর। উত্তাল সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর কক্ষে রাত জেগে হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন তার প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। ১৯৭২-এ কবি-সাহিত্যিক আহমদ ছফার উদ্যোগে এই উপন্যাসটি খান ব্রাদার্স প্রকাশনী সংস্থা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। প্রখ্যাত বাংলা ভাষাশাস্ত্র ও পণ্ডিত আহমদ শরীফ এ গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছিলেন। মুহসীন হলের ওই কক্ষে লেখা প্রথম উপন্যাসটি তখন বাংলাদেশের সাহিত্যামোদি মহলে ব্যাপক আগ্রহ ও আলোড়ন তোলে। সেই উপন্যাসটি তখনই জানান দিয়েছিল একজন হুমায়ূনের আগমনের। বলা চলে, দেশের কথা সাহিত্যের প্রচলিত ধারাটাকেই পাল্টে দেন তিনি। একই সঙ্গে লেখক হিসেবে জন্ম হয় একজন হুমায়ূন আহমেদের। মুহসীন হলের এই কক্ষেই তিনি লিখেছিলেন তার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘শঙ্খনীল কারাগার’। এক অর্থে মুহসীন হলের ৫৬৪ নম্বর কক্ষটিও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অংশ। হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন গ্রন্থেও মুহসীন হলের এই কক্ষের উল্লেখ রয়েছে। বিশেষ করে ‘মাতাল হাওয়া’ গ্রন্থে তিনি ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ের অংশ বিশেষ তুলে ধরেছেন। মুহসীন হলে ম্যাজিক দেখানো, শখের হস্তরেখাবিদ হিসেবে হাত দেখা, হিপনোটাইজ করাসহ নানা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এই গ্রন্থে। তখনকার শাসক আইয়ুব-মোনায়েমের এনএসএফ’র পান্ডারা হলের ৫৬৪ নম্বর রুমে তার বিছানা জ্বালিয়ে দিয়েছিল, স্কলারশিপের টাকায় কেনা তার প্রিয় একটি বই পুড়িয়ে ফেলেছিল, সেই বর্ণনাও আছে এই গ্রন্থে। শুধু মাতাল হাওয়া নয়, হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন গ্রন্থে ৫৬৪ নম্বর কক্ষ নিয়ে তার স্মৃতি ও আগ্রহের বিষয়টি উঠে এসেছে বারবার। লেখক হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর এই কক্ষটি দেখতে গিয়ে তাকে চিনতে না পারা কক্ষের এক শিক্ষার্থীর কড়া প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ফিরে আসার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তার একটি গ্রন্থে।
হুমায়ূন আহমেদের স্মৃতি ঘেরা মুহসীন হলের সেই ৫৬৪ নম্বর কক্ষটি এখন কী অবস্থায় আছে? মঙ্গলবার সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, এই কক্ষের দরজায় সাদা কাগজে কম্পিউটার প্রিন্ট করে লেখা রয়েছে ৫৬৪ ‘হুমায়ূন কুঠির’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী এম এইচ মাহমুদ ও টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সুমন সরকার থাকেন এই কক্ষে। ছোট কক্ষটি এখন ‘হুমায়ূন কুঠির’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে, কক্ষের ভেতরের পরিবেশ অনেকটাই জরাজীর্ণ, অপরিচ্ছন্ন। লোহার জানালার গ্লাস ভাঙা। দেয়ালের রং জ্বলে গেছে। মাঝে মধ্যে পলেস্তারা খসে পড়ে বলে জানান শিক্ষার্থীরা। কক্ষের ভেতরে আলাদা করে তেমন কোন বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে না। কিন্তু ‘হুমায়ূন আহমেদের রুম’ হিসেবে এটিকে চেনেন সবাই। শিক্ষার্থী মাহমুদ জানান, অনেকেই আসেন কক্ষটি দেখতে। বিশেষ করে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর প্রায় নিয়মিতই বিভিন্ন বয়সী হুমায়ূন ভক্তরা এই কক্ষটি দেখতে এসেছেন বলে জানান তিনি। তিনি জানান, দীর্ঘ সময়ে এই কক্ষে অনেকেই থেকেছেন। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি, ব্যবসা করছেন। তারাও মাঝে মধ্যে এসে এই কক্ষে ঢুঁ মেরে যান শুধু হুমায়ূন আহমেদের টানে। তার মৃত্যুর পরেই মুহসীন হলের এই কক্ষটি আরো বেশি করে আলোচনায় এসেছে বলে জানান হলের বেশ কয়েকজন আবাসিক শিক্ষার্থী। তারা জানান, মাঝে মধ্যে এই কক্ষে আড্ডা জমে। আড্ডার বিষয়বস্তুতে হুমায়ূন আহমেদ থাকেন নিশ্চিতভাবেই।
কক্ষের পূর্বদিকে জানালার পাশের দেয়ালে সিমেন্টের স্থায়ী একটি ডেস্ক (টেবিল সদৃশ)। কক্ষের শিক্ষার্থী মাহমুদ বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে যতটুকু জানতে পেরেছি এই ডেস্কে বসেই লিখতেন হুমায়ূন আহমেদ। এর পাশেই ছিল তার ছোট বিছানা। এখানে বসেই নাকি তিনি লিখেছিলেন জনপ্রিয় উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ ও শঙ্খনীল কারাগার’।’ তিনি বলেন, এমন একজন মহান সাহিত্যিক এই রুমে থাকতেন। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় এখানেই কাটিয়েছেন। এখানেই লেখালেখির জীবন শুরু করেছেন। আর এখন আমরা এই রুমে থাকি, এতে আমাদের গর্ব হয়। আমরা এটিকে ‘হুমায়ূন আহমেদের রুম’ বলে পরিচিত করেছি। ‘হুমায়ূন কুঠির’ নাম দিয়েছি। বিভিন্ন সময়ে নানা বয়সী মানুষ এই রুম দেখতে আসেন। রুমটির আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ নামটিই এই রুমকে বৈশিষ্ট্যময় করে তুলেছে।’ তিনি বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের রেখে যাওয়া কোনো স্মৃতি এখানে নেই। কিন্তু এই ৫৬৪ নম্বর কক্ষে তিনি থাকতেন, এটাই বড় স্মৃতি। হুমায়ূন আহমেদের ভক্ত হিসেবে আমরা চাই এই কক্ষটিকে সংরক্ষণ করা হোক।’ পাশের ৫৬৩ নম্বর কক্ষে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মামনুন হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মাঝে মধ্যে ওই রুমে আড্ডা দিই। বেশিরভাগ সময়জুড়ে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়েই আলোচনা হয়। আমাদের ভাবতে ভালো লাগে যে রুমে হুমায়ূন আহমেদ থাকতেন তার পাশের রুমে আমরা থাকি। অনেকেই এই রুমটি দেখতে আসেন।’