× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

জলাবদ্ধতার অণুকাব্য

এক্সক্লুসিভ

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে
১৫ জুলাই ২০১৯, সোমবার

জলাবদ্ধতা। ভয়ঙ্কর এক নাম। দীর্ঘ দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম নগরবাসীর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেই চলেছে এই দৈত্য। যা কালক্রমে শুধু বাড়ছেই। এই দৈত্য নগরবাসীকে যেমন ভোগাচ্ছে, তেমনি রসিকজনরাও স্বার্থ চরিতার্থ করছে সুযোগ বুঝে।
বিশেষ করে রাজনীতির স্বার্থে এমন রসিকতা আমরা বার বার  শুনেছি-‘চাটগাঁ নাকি সিঙ্গাপুর, পানির তলে কা মুরাদপুর। সম্প্রতি এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন আরো কিছু খনার বচন। তন্মধ্যে আকর্ষণীয় হলো- কে বলেছে চকবাজার, এটা মোদের কক্সবাজার।
বাসার নিচে সৈকতের পানি, ভয় নেই মোরা সাঁতার জানি।
গ্রাম হবে শহর, শহর হবে সাগর। উড়াল সড়ক নিয়েও বলা হচ্ছে- এ যেন স্রোতস্বিনী নদী। নদীর উপর নদী। এমন আরো কত কী। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে মুখরোচক শিরোনাম কম হয়নি। ২০১৫ সালের এমন দিনে আমি নিজেও জনপ্রিয় একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রতিবেদন করি-চট্টগ্রাম যেন বহমান নদী।
এরপর একই শিরোনামে আরো কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে। যদিও সেই জলাবদ্ধতার সঙ্গে চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতার রয়েছে কিছুটা ফারাক।
এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের মতো ঢাকার পাশে নেই কোনো সমুদ্র। আছে বুড়িগঙ্গাসহ কয়েকটি নদী। তেমনি চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানেও প্রবাহিত হচ্ছে স্রোতস্বিনী কর্ণফুলী, হালদা, সাঙ্গু ও ইছামতিসহ পলিবাহিত অনেক নদী। যাদের তীর থেকে তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত পাহাড়ও।
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতায় নিরেট ভূমিকা পালন করছে এসব পাহাড়। তবে পাহাড়ের কীর্তন নিয়ে আমরা পরে আসছি। আগে নিয়ে আসছি বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম মহানগরে তা কেন আটকে যায় তার সাতকাহন। কারণ জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি আটকে থাকার প্রশ্নটি মৌলিক।
আমরা বলি ও জানি- জল নিচের দিকে গড়ায়। আর তা নালা-নর্দমা হয়ে খালে-বিলে, নদীতে, নদী থেকে সাগরে গড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর থেকে পানি কেন গড়িয়ে পড়ে না। উল্টো সড়ক-মহাসড়ক, দালানকোঠা ও বাসাবাড়িতে ঠাঁই নেই। মুরাদপুর কেন পানির নিচে? চকবাজার কেন কক্সবাজার?
এমন প্রশ্নের সহজ কাব্য-সড়ক-মহাসড়ক থেকে নালা-নর্দমা নিশ্চয় উঁচু। যদি তা না হয়, তাহলে খাল উঁচু, তাও যদি না হয়, তাহলে নদী উঁচু, তাও যদি না হয়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু। পানির ধর্ম উঁচুর দিকে না গড়ানো, তাতে নিচু শহর তো সাগর হবেই।
আর সেই উঁচু জায়গাগুলো নিচু করে দিলেই তো পানি নিচের দিকে গড়াবে। আরেক সহজ কাব্য হচ্ছে-সাগর, নদী, খাল ও নালা-নর্দমা থেকে চট্টগ্রাম মহানগরকে উঁচু করা। তখন পানি উঁচু শহর থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে না। এটাই তো স্বাভাবিক।
আর এই কাজটুকু আমরা কেন করতে পারছি না। জলাবদ্ধতার জন্য আমরা নগরীর অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ৬৭টি খাল, কর্ণফুলী ও হালদা নদী ভরাট, দখল ও দূষণকে দায়ী করছি। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কথাও বলছি।
তবে যা বলছি, তা তো অমূলক নয়। নগর থেকে পানি নিচের দিকে না গড়ানোর মূলেই তো প্রতিবন্ধকতা। এই প্রতিবন্ধকতা হতে পারে নালা-নর্দমা, খাল ও নদী ভরাটের কারণে। হতে পারে দখলদারিত্বের কারণে।
নগরীতে দেখা যায়, নালা ও খালের উপর প্রভাবশালী অনেকের বড় বড় দালান। যার সঙ্গে বৃষ্টির পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে চট্টগ্রাম মহানগরে। আর এসব দালান সরাতে বা নালা-নর্দমার ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করতে নেয়া হচ্ছে হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প। শুধু কি তাই; এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ক্ষেপণ হচ্ছে বছরের পর বছরও।
আসলেই কী প্রয়োজন মেগা প্রকল্পের? না কি প্রয়োজন প্রকৃত বিশেষজ্ঞের। যিনি পানির গতি স্বাভাবিক করতে উঁচুকে নিচু, নিচুকে উঁচু করার মতো সঠিক পদক্ষেপ নেবেন। উঁচু-নিচুর সরলপথে বৃষ্টির পানি ঠিক কোন জায়গায় আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে তা চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে জনগণের অর্থের অপচয় ঘটাবেন না। কালক্ষেপণ করে নগরবাসীর দুর্ভোগ বাড়াবেন না।
আসুন এবার জলাবদ্ধতায় নালা-নর্দমা, খাল, নদী ও সাগরের ভূমিকার যবনিকাপাত ঘটাই। এটা স্বাভাবিক যে, পলির কারণে সাগরের উচ্চতা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণে বাংলাদেশের মতো ভাটি অঞ্চলের দেশগুলো রয়েছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে।
উন্নত বিশ্বের জলবায়ুবিদরা এ নিয়ে বার বার সতর্কতাও দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। একটা কথা আছে-শুনার মতো শ্রবণশক্তি থাকলেই তো শুনবো। বোঝার মতো মেধা থাকলেই তো বুঝবো। দায়িত্বশীলদের ক্ষেত্রে এটি এখন বড় বিষয়। তবে শ্রবণশক্তি যাদের আছে কৌশলের কাছে তারা বধির। মেধাবীরা অন্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ‘প্রসিডিংস অব দ্যা ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস’ নামের জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২১০০ সাল নাগাদ ধারণার চেয়েও দ্বিগুণ বাড়বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। যা প্রায় দুই মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এতে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের মতো নিচু এলাকার ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। যার হুমকিতে রয়েছে চট্টগ্রাম।
অথচ এসব সতর্কতার প্রতি কারো কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। যত ভয় শুধু পানিবন্দি মানুষের। যারা সামান্য জোয়ারের পানিতে সকাল-সন্ধ্যা ও মাঝারি বৃষ্টিপাতেও হাঁটু থেকে গলা সমান পানিতে ডুবে থাকে। নিরন্তর দুর্ভোগ পোহায় নিত্যদিন।
দেশের আবহাওয়াবিদরাও স্বীকার করেন যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে লোকালয়ে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে। বৃষ্টির পানি আটকে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। আর সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির মূল কারণ পলি। পলির উৎপত্তি জমিনের পেরেক খ্যাত পাহাড় কাটা থেকে। যা বর্ষার জলে উজান থেকে নেমে খাল-বিল, নদী ও সাগর ভরাট করে দিচ্ছে।
পাহাড় কাটার মাটি নেমে ভরাট হচ্ছে নগরীর নালা-নর্দমাও। যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ময়লা-আবর্জনাও। নালার উপর ভবন তো আছেই। যার কারণে পানি চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও পানি আটকে চট্টগ্রাম মহানগরজুড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।
আর এই সরল কাব্যটাকে খুঁজতে হাজার কোটি টাকায় ম্যাগনিফাইং গ্লাস কেনার ব্যবস্থা করছি আমরা। তাও নির্ণয় না জানার কারণে প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। তাতে হচ্ছে না প্রয়োজনীয় ওষুধ প্রয়োগের ব্যবস্থাও।
এবার আসছি পাহাড় কাটার ইতিবৃত্ত নিয়ে। চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা-উপজেলা পাহাড়বেষ্টিত সেটা সবারই জানা। যেগুলোর বুকে শাবলের আঘাত চলছে রাত-দিন। পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ, পুকুর, খাল-বিল ভরাট, সড়ক তৈরিসহ সরকারি উন্নয়ন কাজেও পাহাড় কাটা মাটি দিয়ে চলছে। ক্ষমতাসীন দলের যেন মহাশত্রু এই পাহাড়।
পাহাড় কাটার সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে কত কালে হামলা-মামলা ও ঘরছাড়া হতে হয়েছে অনেক গণমাধ্যমকর্মীদের। যার শিকার আমি নিজেও। পাহাড় কাটার ছবি তোলার সময় ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে দুর্বৃত্তরা পিঠও ভাঙলো, ভাঙলো দামি ডিএসএল ক্যামেরাটাও। তখন আমি দেশের প্রভাবশালী একটি দৈনিকের প্রতিনিধিত্ব করছিলাম। কিন্তু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাবে তার কোনো প্রতিকার পাইনি। চলছে পাহাড় কাটাও।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর