জেলাজুড়ে নদী-হাওরের পানি বেড়েই চলছে। টানা ভারি বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে হঠাৎ দ্রুতগতিতে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে জেলার সবক’টি হাওর ও নদীর। এতে করে নদী ও হাওর তীরের বাসিন্দাদের বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বাঁধ ভাঙনের ভয়ে এখন তাদের রাতদিন একাকার। জেলার মনু ও ধলাইয়ের মতো কুশিয়ারা নদী তীরের মানুষের বাঁধ ভাঙনের এই দুর্ভোগই যেন তাদের নিয়তি। প্রায় দুই যুগ থেকে কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা এলাকায় একই স্থানে ভাঙছে বাঁধ। কিন্তু বাঁধটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ হচ্ছে না। গেল ক’দিন থেকে ক্ষেপেছে কুশিয়ারা নদী। উজানের পাহাড়ি ঢল আর গেল ক’দিনের ভারি বর্ষণে আগ্রাসী হচ্ছে কুশিয়ারা।
এখন ধীরে ধীরে নদী দেখাচ্ছে তার ভয়ঙ্কর রাক্ষুসে স্বভাব। প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ভেঙে এই ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা পানিবন্দি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহান। কিন্তু তা থেকে উত্তরণে কিছুতেই টনক নড়ে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বাঁধ নির্মাণের স্থায়ী প্রতিকার চেয়ে নানা স্থানেও ধরনা দিয়েও শুধু প্রতিশ্রুতি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয় না। তাই দীর্ঘদিন থেকে বর্ষা এলেই ওই স্থানের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয় গ্রামের পর গ্রাম। আকস্মিক বন্যায় সব হারিয়ে চরম ক্ষতিগস্ত হন কয়েক হাজার মানুষ। ক্ষোভের সঙ্গে এমনটি জানালেন আকস্মিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় দুর্ভোগগ্রস্তরা। ওই এলাকাবাসী জানান, শনিবার বিকাল থেকেই ভাঙন শুরু হয় কুশিয়ারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের। এখন পর্যন্ত সেই ভয়ার্ত উত্তাল স্বরূপ অব্যাহত রেখেছে কুশিয়ারা। শনিবার বিকালে থেকে অল্প অল্প করে ভাঙন শুরু হয় খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা এলাকায়। ওইদিন মধ্যরাতেই ওই ভাঙন বড় হয়ে প্রায় ৩শ’ ফুট বাঁধ ভেঙে পানি ঢোকে একাধিক গ্রামে। গত রোববার বিকাল খলিলপুর ইউনিয়নের ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। আকস্মিক ওই বানের পানিতে ভেসে যায় হামরকোনা, ব্রাহ্মণগ্রাম, দাউদপুর, শেরপুর,আলীপুর গ্রাম। ঘরবাড়ি, ক্ষেতকৃষি, মৎস্য খামার, স্কুল-মাদ্রাসা, মক্তব-মসজিদ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সবই গ্রাস করেছে পানি। হঠাৎ বন্যার কবলে পড়ে ওই গ্রামগুলোর প্রায় ১০-১৫ হাজার বাসিন্দা সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব। ঘরবাড়ি ছেড়ে তারা অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। হামরকোনা এলাকার প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় জামেয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। অনেকেই নিরাপদ আশ্রয় না পেয়ে সিলেট-মৌলভীবাজার সড়কের পাশেই অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘর ও ডেরা বানিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন। ওখানে কোনোরকম আশ্রয় নেয়া লোকগুলো অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে আছেন বলে জানিয়েছেন। এখন সময় যত যাচ্ছে নদীর পানি বাড়ছে। এরই সঙ্গে নতুন করে বানের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নদী তীরবর্তী গ্রামও। হামরকোনা গ্রামের বাসিন্দা বন্যাকবলিত মো. জাকার মিয়া, আখলিমা বেগম, মিনারা বেগম, আবেদ আলী, উমর আলী, কমর আলী, আব্বাস উদ্দিন ও হালেমা বেগম অভিযোগ করে জানান প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ওখান দিয়ে বাঁধ ভাঙে আমাদের সব কিছু কেড়ে নেয়। প্রতিবছরই ওই পরিস্থিতিতে পড়ে যুদ্ধ করে কোনো রকম টিকে থাকি নিজের বসত ভিটায়। তারা কেঁদে কেঁদে বলেন- আমাদের বয়ে চলা এই দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চরম উদাসীন। তারা প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রতিবছরই এই স্থানটি ভাঙে তারপরও কেন কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙে না? বর্ষা মৌসুমে দায়সারা গোছের টুকটাক মেরামত করেই যেন সব দায় দায়িত্ব শেষ। বন্যার খবর পেলে দু’-চার প্যাকেট শুকনো খাবার দিয়েই জনপ্রতিনিধিদের খবরদারী শেষ। বন্যা কবলিতরা বলেন- সব হারিয়ে এখন আমরা মানবেতর জীবন-যাপন করছি। আমরা ত্রাণ নয় এখনকার বাঁধের স্থায়ী সমাধান চাই। গতকাল বিকালে হামরকোনা এলাকায় গেলে দেখা মিলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ গ্রামবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মেরামত করছেন। ঐ গ্রামের যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী প্রভাষক লুৎফর রহমান ও গ্রামবাসীর অর্থায়নে ও সার্বিক সহযোগিতায় স্থানীয়রা তা মেরামত করছেন। বাঁধে কাজ করা স্বেচ্ছাশ্রমি অনেকেই বলেন, সরকার যখন আমাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসে না তখন তো আমাদের কাজ করা ছাড়া উপায় নেই। তবে আমাদের এই মেরামত কাজগুলো অস্থায়ী। বাঁধ মেরামতের সার্বিক তদারকির দায়িত্বে থাকা খলিলপুর ইউপি সদস্য মো. তাহির উদ্দিন বলেন, এই এলাকার দীর্ঘদিনের দাবি এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটি নির্মাণের। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-মরণ সমস্যার এই বাঁধটির স্থায়ী কোনো সমাধান হচ্ছে না। আমরা আমাদের মতো করে মেরামত করছি। কিন্তু তা স্থায়ী হচ্ছে না। আমাদের জোর দাবি এ অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের সমস্যা লাঘবে সরকার যেন ওই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করে দেন। এদিকে গতকাল সকালে একই এলাকায় কুশিয়ারা নদীর ৩টি স্থানে নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ওই এলাকার দরাধরপুর, কেশবচর, চানপুর, আলাপুরসহ কয়েকটি গ্রাম। বন্যাকবলিত হয়েছেন ওই এলাকার কয়েক হাজার মানুষ। নতুন করে ভাঙন দেখা দেয়ায় কুশিয়ারা নদীর আশপাশ এলাকার বেশ কয়টি গ্রাম প্লাবনের হুমকিতে পড়েছে। হামরকোনা গ্রামের শহীদ মিয়া, ফরহাদ মিয়া, মো. নাজিম উদ্দিন জানান শনিবারের ভাঙন গ্রামবাসীর চেষ্টায় অনেকটা রোধ করা সম্ভব হলেও এখন নতুন করে কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়ায় আমরা চরম আতঙ্কে আছি। তারা জানান, বন্যায় ঘরবাড়ি ছাড়া লোকজন খাদ্য সংকটে পড়েছেন। সরকারি তরফে যে খাবার বা চাল দেয়া হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। বন্যার্তদের সহায়তার বিষয়ে মৌলভীবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এ পর্যন্ত সদর উপজেলায় বন্যাকবলিতদের মধ্যে ৮শ’ প্যাকেট শুকনো খাবার ও ৯শ’ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আমাদের ত্রাণ সামগ্রী প্রস্তুত রয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো ত্রাণ বিতরণ করা হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ড মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী মানবজমিনকে জানান, কুশিয়ারা নদীর হামরকোনা এলাকার বাঁধ স্থায়ীভাবে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এখন অস্থায়ীভাবে বাঁধ মেরামত করা হবে। আর পানি কমলে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। তবে সে ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দাদের সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন। এদিকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত মনু নদীর দু’টি স্থানে বিপদসীমার ১০০ ও ৩৫ সেন্টি মিটার, কুশিয়ারী নদী ৫৪ সেন্টি মিটার ও ধলাই নদী বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।