× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সাঁওতালদের সাত সতেরো

ষোলো আনা

পিয়াস সরকার
৩০ আগস্ট ২০১৯, শুক্রবার
ছবি: নূর নবী খান

বাংলাদেশের বৃহৎ আদিবাসী জনগোষ্ঠী সাঁওতাল। তারা সান্তাল, সান্তালি, হোর, হর ইত্যাদি নামেও পরিচিত। মূলত বাংলাদেশে রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলায় তাদের বাস। এ ছাড়াও কিছু সাঁওতালদের বাস পার্বত্য চট্টগ্রাম, পাবনা, যশোর ও খুলনায়। তারা মূলত বাংলাদেশ অংশে আসেন ১৮৪০ থেকে ১৯৪০ সাল, এই ১০০ বছরে। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী সাঁওতালদের সংখ্যা ২ লাখেরও বেশি।
 
সাঁওতালরা বিশ্বাস করেন আদি মানব-মানবী পিলচু বুড়ো ও পিলচো বুড়ির সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব। এ জন্য তারা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। এগুলো হলো হাঁসদা, সরেন, টুডু, কিসকু, মুর্মু, মাণ্ডি, বাস্কে বেসরা।
তারা সূর্যকে মূলত মেনে চলে। সূর্যকে সিংবঙ্গা, মারাং বুরু বলেন। তাদের ধর্মের নাম সারি ধরম। আর গরুকে খুবই যত্নের সঙ্গে লালনপালন করেন। তারা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন। এ ছাড়া তাদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা মুণ্ডা। এই ভাষাটি অক্ষরহীন। তবে ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিরা কয়েকটি স্কুলে ইংরেজিতে তাদের ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়। বাংলাদেশে তাদের সাক্ষরতার হার প্রায় ৫০ শতাংশ।

সাঁওতালদের শরীরের গড়ন মধ্যম আকৃতির হয়। ত্বকের রং গাঢ়। পুরু ঠোঁট, চ্যাপ্টা নাক, কোকড়ানো চুল। সুঠাম দেহের অধিকারী। তাদের ঘরগুলো মাটির হয় সাধারণত। তারা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। পুরুষরা আগে সাদা থান পরলেও এখন পরেন লুঙ্গি, ধুতি। আর গামছা তাদের সঙ্গী। আর নারীরা এখন শাড়ি পরেন। আগে তারা ফতা নামে দু’খণ্ডের পোশাক পরিধান করতেন। তবে কোনো অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তারা থান ও ফতা পরে থাকেন। পুরুষদের হাতে লক্ষণীয় উল্কির ছাপ। আর নারীরা বালা, ঝুমকা, আংটি, মল, হাঁসুলি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। মৃতদেহ দাহের প্রথা থাকলেও এখন তারা কবর দিয়ে থাকেন। বাঙালি খাবারের পাশাপাশি তারা ঝিনুক, শামুক, কাঁকড়া, শূকর, মুরগি, খরগোশের মাংস, ইঁদুর, বেজি ইত্যাদি খেয়ে থাকেন। শিকারী জাতি হিসেবে পরিচিত সাঁওতালরা। বর্তমানে তাদের প্রধান কাজ কৃষি। এ ছাড়াও শ্রমিক হিসেবেও তাদের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আর তাদের বাঁশের কাজে রয়েছে আলাদা খ্যাতি।  

সাঁওতালরা পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে থাকে না মেয়েদের কোনো অধিকার। তবে সম্পত্তি বণ্টনের সময় সাধ্য থাকলে পিতা মেয়েদের একটি করে গাভী উপহার দিয়ে থাকেন। আর ছেলে সন্তান না থাকলে ভাইয়েরা তার মালিক হন।

বিয়ে: জামাই সাজা দিয়ালে
‘নেপেল’। বিয়ের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ। এটি কন্যা দেখার অনুষ্ঠান। তারা সাধারণ পোশাকেই আসেন। বিয়ের বিষয়ে ভগ্নিপতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কনে দেখতে এসে পরস্পরকে প্রণাম করেন। এরপর পাটিতে বসে কনে দেখাপর্ব শেষ হয়। আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে দেয়া হয় চুন ও তামাক। সেটি হাতের তালুতে ঘঁষে উপস্থাপন করা হয় সকলের উদ্দেশ্যে। উভয়ের পছন্দ হলে বাড়িতে বাজে অনুষ্ঠানের ঢঙ্কা। মেয়ের বাড়িতে পাঠানো হয় উপঢৌকন। বিয়ে বাড়ির প্রধান আকর্ষণ গনং গান ও হাঁড়িয়া। হাঁড়িয়া হচ্ছে তাদের নিজস্ব তৈরি পানীয়। যা ভাত পচিয়ে তৈরি করা হয়। বিয়ের দিন গামছা বিছিয়ে বসে থাকেন বর-কনে। সেখানে আশীর্বাদ করে আত্মীয়স্বজনরা উপহার দিয়ে থাকেন। আর মেয়ের বাড়িতে সারা রাত ধরে চলে গান বাজনা। এরপর কিছুদিন বাদে নির্ধারিত দিনে অনুষ্ঠান হয় ছেলের বাড়িতে। এই অনুষ্ঠানের নাম ‘জামাই সাজা দিয়ালে’। অনুষ্ঠানে সুতায় দেয়া হয় তিনটি গিঁরো। যা কাঁঠাল পাতা ও ঘাস পাতা দিয়ে হাঁড়িতে রাখা হয়। তিনদিন একটি করে গিঁরো খুলেন বর-কনে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলের বাড়িতে শূকর পালা হয়। যা বিয়ের দিন রান্
 
না করে পরিবেশন করাহয়। সাঁওতালরা তাদের সর্দারকে বলেন ‘মহৎমণ্ডল’। মহৎমণ্ডলরা বাঁশের খুঁটি ও ডালপালা দিয়ে বর-কনের বাড়িতে ছাউনি বা মণ্ডোয়া তৈরি করেন। আর তার চারপাশে দেয়া হয় সিঁদুর, দূর্বাঘাস, আতপ চাল, কলাপাতা ইত্যাদি। এর পাশ ঘিরে করা হয় ‘দাক বাপলা’ নামে গানের অনুষ্ঠান। তাদের অন্যতম প্রধান প্রতীক তীর ধনুক। গানের মঞ্চে এই তীর ধনুক থাকবেই। ছেলের বাড়ি থেকে নাচতে নাচতে গ্রামের  শেষ মাথায় যান এবং মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে ঢালা হয় পানি। এরপর প্রণাম শেষে গর্তে তীর ছুড়েন তারা। আনুষ্ঠানিকতা শেষে মেয়ের বাড়িতে যাবার পালা। বরের সঙ্গে যারা যান তাদের বলা হয় ‘এরগত’। অনুষ্ঠানের শেষ হয় ‘মানজিহিতান’-এ। সামাজিক প্রথা অনুযায়ী মানজিহিতানকে প্রণাম করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। মানজিহিতান হচ্ছে গ্রামের সর্দারের বাড়িতে তৈরি উঁচু মাটির ঢিবি। মূলত মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দেয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন হয় বিয়ে। এই বিয়েকে বলা হয় আসলি বিয়ে। সাঁওতালদের নিজ গোত্রে বিয়ে হয় না।

এ ছাড়াও দুই ধরনের বিয়ে হয়। ‘রাজারাজি’। এটি হলো প্রেমঘটিত বিয়ে। সাঁওতালদের প্রত্যেক গ্রামেই বছরে একবার বিয়ের উদ্দেশ্যে হাট বসে। এই দিনে যুবক- যুবতীরা ইচ্ছামতো নিজের প্রিয়জনকে বেছে নেন। আরেকটি বিয়ের প্রথা ‘হুর কাটারা’। এটি হচ্ছে জোর করে বিবাহ। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে ছেলে তাকে জানায়। কিন্তু মেয়ে রাজি না হলে  জোরপূর্বক সিঁদুর পরিয়ে দেন। অবিবাহিত যুবতীর কপালে সিঁদুর পরালে সেই মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হয় না। মাতব্বরা সেই ছেলেকে অর্থদণ্ড দিয়ে বিয়ের কাজ সমাধান করেন। তবে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত এই মানুষগুলো এখন তাদের রীতি থেকে ধীরে ধীরে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অনেকে শিক্ষা লাভের পর বেছে নিচ্ছেন আধুনিক রীতিনীতি।

সাঁওতালরা বেশ উৎসবপ্রিয়। তাদের প্রধান উৎসব বাহা। বসন্তের শুরুতে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এই বাহা’তেই বসে বিয়ের হাট। ফাল্গুনে পালন করেন স্যালসেই, চৈত্রে  বোঙ্গাবোঙ্গি, বৈশাখে হোম, আশ্বিনে দিবি, পৌষ  শেষে সোহরাই উৎসব পালিত হয়। এ ছাড়াও ভাণ্ডান, ফতে, বারনি তারা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করে থাকেন। তাদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র ঢোল। এ ছাড়াও দোতারা, কয়েক প্রকারের বাঁশি, মেগো, খুমুর, ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে থাকেন। আর হাঁড়ির গায়ে পয়সা দিয়েও অপূর্ব এক সুর তোলেন তারা। আর বাড়িতে ছবি আঁকাও একটি শিল্প তাদের।

সাঁওতালদের গর্ব
৩০শে জুন ১৮৫৫। এই দিনে বৃটিশদের সঙ্গে গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তারা। এটি জুন বিদ্রোহ বা ‘হুল’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া ২০০৩ সাল থেকে ২২শে ডিসেম্বর সাঁওতালী ভাষা ভারতের রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা লাভ করে। এই দিনে ভারতের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশের সাঁওতালরাও ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন। মুক্তিযুদ্ধেও আছে তাদের গৌরবময় অবদান।
<


সরজমিন সাঁওতালপল্লী
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলা। এখানকার শঠিবাড়ি নামক স্থানে রয়েছে সাঁওতালপল্লী। পল্লীতে প্রায় ৪০টির মতো বাড়ি। জনসংখ্যার চাপে এটি পরিণত হয়েছে বস্তিতে। কোনো রকম মাথাগোঁজার ঠাঁই। পল্লীতে দারিদ্র্যতার ছাপ স্পষ্ট। অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। দুপুর বেলা পল্লী প্রায় লোকশূন্য। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলে গেছেন কাজে। বয়সের ভারে কাবু ইকুয়া ভারডিক। উঠানে বসে মরিচ বাটছিলেন। তিনি জানান, খেয়ে না খেয়ে বাস তাদের। সন্তানরা একদিন কাজ না পেলে উপোস কাটাতে হয় প্রায়শই। ৪০ বছর বয়সী আরেয়ী ভারডিক করছিলেন বাঁশের কাজ। তিনি জানান, এই চারটা বাঁশের বেত বের করে পাবেন ৮শ’ টাকা। কিন্তু এই কাজ কোনো বাঙালি করলে দেয়া হয় ১ হাজার টাকা। অর্থাৎ তাকে দেয়া হয় প্রতি বাঁশে ৫০ টাকা করে কম। এ ছাড়াও তিনি জানান, কৃষি শ্রমিক হিসেবে অন্য পুরুষদের দেয়া হয় দৈনিক মৌসুম ভেদে ২শ’ থেকে ৬শ’ টাকা। সেখানে তারা পান দেড়শ’ থেকে ৫শ’ টাকা।

তাদের সন্তানরা দিনের বেলা শামুক, মাছ ধরে থাকেন। কিন্তু দিনকে দিন তার সংখ্যাও কমে আসছে। এখন সারাদিন খুঁজেও তারা মেলাতে পারে না শামুক। আর এই বাচ্চাদের অধিকাংশের গণ্ডি প্রাথমিক পর্যন্তই। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে একই স্কুলে গেলেও পড়তে হয় নানা সমস্যায়। ভিন্ন চোখে দেখা হয় তাদের। ইমন নামে চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী জানান, অনেক সময় তাদের পাশে বসতে চান না অন্যরা। আবার হয় মনোমানিল্য।
আপন বিস্মা বলেন, আমাদের সঙ্গে প্রায়শই বিবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা পল্লীভুক্ত হয়ে আছি এখানে। আর আমাদের ওপর যেন নির্বিচারে বিবাদ সৃষ্টি করা যায়। বাঙালি আফজাল রহমান বলেন, তাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে আছি। আমাদের মাঝে বিবাদ নেই। তবে সমস্যাটা হচ্ছে অন্যের সঙ্গে বিবাদ হলে সেটি হয় পরিবারে পরিবারে। কিন্তু তাদের সঙ্গে হলে ছড়িয়ে যায় পাড়ায়। এই কারণেই এই সমস্যা দেখা দেয়।

সাঁওতালদের জীবনযাপন অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। নেই স্যানিটেশনের ব্যবস্থা। রোগ লেগেই রয়েছে পল্লীজুড়ে। আর কুসংস্কারে জর্জরিত তারা। এখনো তাদের প্রধান চিকিৎসা তাবিজ কবজ। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার আগে আগে আসতে থাকেন তারা। সারা দিনের আয়ের টাকা দিয়ে কিনে আনা চাল-ডালই তাদের ভরসা।  নারীরা প্রস্তুতি নেন রান্নার।

ননয় মিরাস বলেন, আমরা আমাদের পৈত্রিক ভূমিতে শান্তিতে দিন কাটাতে চাই।
পল্লীর প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও অধিকাংশের ঘরে তা সীমাবদ্ধ একটি লাল বাতিতেই। অল্প কিছু ফ্যানের দেখা মেলে সেখানে। এভাবেই রাতের খাবারের পালা শেষে ঘুমিয়ে পড়েন তারা। পরিশ্রান্ত দেহ বিছানায় বিলিয়ে দিয়েই ঘুম। পরদিন ফের সকালে যেতে হবে কাজে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর