তিন ভাই। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, মাসুদ হাসান ভূঁইয়া ও হাসান মাহমুদ ভূঁইয়া। পুরো পরিবার জড়িত টেন্ডার-চাঁদাবাজিতে। তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ, রেলওয়ে ও গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। পুঁজি ছাড়াই কামিয়েছে কোটি কোটি টাকা। তবে বড় ভাই ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূইয়া গ্রেপ্তারের পর গাঢাকা দিয়েছেন তার অন্য দুই ভাই। অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেন্ডারবাজিতে এ পরিবার এত মজেছিল যে, চার বছর আগে পড়াশোনা করতে লন্ডন যান হাসান মাহমুদ ভূইয়া। টেন্ডারবাজিতে ভাইয়ের রমরমা অবস্থা দেখে পড়াশোনা শেষ না করেই দেশে ফিরে আসেন তিনি।
দায়িত্ব নেন টর্চার সেলের। আরেক ভাই মাসুদ হাসান ভূইয়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি দেখভাল করতেন। তিন ভাইয়ের পাশাপাশি বড় বোন জামাই মো. ফারুক এখন কোটিপতি। মোহাম্মদপুরে অট্টালিকা সদৃশ বাড়ি করেছেন। দুই ভাই মাসুদ হাসান ভূইয়া ও হাসান মাহমুদ ভূইয়ার ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও বসুন্ধরায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার পরিবার ছিল বিএনপি’র একনিষ্ঠ সমর্থক। তার বাবা আব্দুল মান্নান ভূইয়া বিএনপি’র আমলে হাইকোর্টের সহকারী এটর্নী জেনারেল পদে নিয়োগ পান। এরপর দীর্ঘদিন ওই পদে কাজ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি আমলে কুমিল্লার বরুড়া থেকে মনোনয়নের চেষ্টা করেন খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার বাবা আব্দুল মান্নান ভূইয়া। যদিও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে মনোয়নের চেষ্টা করেন খালেদ মাহমুদ। এদিকে খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার ছোট ভাই মাসুদ হাসান ভূইয়া রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)-এর টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন। তার গ্রিন সিগন্যালের বাইরে ঠিকাদাররা কাজ পেতেন না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খালেদের ছোট ভাই হাসান রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উল্টো দিকে ইস্টার্ন কমলাপুর টাওয়ারে অফিস করতেন। ওই অফিসটিই টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতেন খালেদ মাহমুদ। খালেদের অস্ত্র ভান্ডার এ অফিস থেকেই দেখভাল করতেন তার ভাই হাসান। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ৪ বছর আগে টর্চার সেলের ফ্ল্যাটটি ক্রয় করেন খালেদ মাহমুদ। এ ফ্ল্যাটে শ্বশুর-শাশুড়ি, স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ থাকতেন। এরপর সেটি টর্চার সেল কাম অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, উত্তরা তৃতীয় পর্যায় প্রকল্প, ঝিলিমিল প্রকল্পে ১০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম মেয়াদে টেন্ডার নিয়ে কোন কথা উঠেনি। তবে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী পদে টিপু সুলতান দায়িত্ব নেয়ার পরই খালেদ মাহমুদের টেন্ডার বাণিজ্য শুরু হয়। ওই কর্মকর্তা যতদিন রাজউকে কর্মরত ছিলেন ততদিন সাধারণ ঠিকাদাররা ছিলেন নির্যাতিত। কেউ কিছু বলার সাহস পেতেন না। পূর্বাচল প্রকল্পের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, কিছু অসাধু ঠিকাদারদের কারণে রাজউকে খালেদ মাহমুদের সাম্রাজের বিস্তৃতি ঘটে। গত দুই বছর ধরে খালেদ মাহমুদের পক্ষ হয়ে কয়েকজন ঠিকাদার কাজ ভাগাভাগি করছেন। যুবলীগ নেতা খালেদকে বেশি কষ্ট করতে হতো না। তিনি তার ভাগ বাসায় বসেই পেয়ে যান। কোন গ্রুপ ঝামেলা করতে চাইলে নিজের বাহিনী রাজউকে পাঠিয়ে দিতেন। প্রকৌশল শাখার এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, টেন্ডার বাণিজ্যে অদৃশ্য হাতের ইশারার বিষয়টি আমরা টের পেতাম। কিন্তু নিজের মানসম্মানের ভয়ে কিছুই বলতে পারতাম না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার তালিকা অনুযায়ি ঠিকাদাররা সিডিউল কিনতেন। কোন সিডিউলের বিপরীতে কত পার্সেন্ট দিতে হবে তাও ঠিক করে দিতেন খালেদ মাহমুদ ভূইয়ার ভাই হাসান। এরপর ঠিকাদারদের কাছ থেকে টেন্ডার বাণিজ্যের অর্থ তোলার কাজটি করতেন তিনি। রাজউকের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, কাগজপত্র ঠিক থাকলে টেন্ডার বাণিজ্য হলেও আমাদের কিছু করার ছিল না। নিয়ম অনুযায়ি আমাদের ওয়ার্ক অর্ডার দিতে হতো।