বিভিন্ন ব্যাংকের ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতাদের প্রণোদনা দিতে ২০১৫ সালের ১৯শে মার্চ প্রথমবারের মতো বিশেষ নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সাড়ে ৪ বছর পার হলেও সেই নীতিমালার কোনো কার্যক্রম বা অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বিশ্লেষকরা জানান, ভালো গ্রাহকদের জন্য কিছুই করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু সার্কুলার জারি করেই দায় সেরেছে। এ যাবৎ যত সার্কুলার জারি করা হয়েছে সবগুলোই খেলাপিদের পক্ষে গেছে অর্থাৎ যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করে না, তাদের নীতি-সহায়তার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে। সর্বশেষ মে মাসের বহুল আলোচিত সার্কুলারের মাধ্যমে খেলাপিদের সুযোগ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তারা।
একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ঋণখেলাপির সুদের হার ৯ শতাংশ।
আর একজন ভালো গ্রাহকের সুদের হার ১২-১৪ শতাংশ। আবার খেলাপিরা ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ পরিশোধে সুবিধা হিসেবে পাচ্ছেন আরো ১ বছরের গ্রেস পিরিয়ড। এছাড়া ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা। দীর্ঘ শুনানি শেষে গত রোববার আদালত বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারকে বৈধ বলে আদেশ দেন। কিন্তু ভালো গ্রাহকদের জন্য কিছুই হচ্ছে না। ফলে ভালো গ্রাহকরাও খেলাপি হতে উদ্বুদ্ধ হবেন। এর দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারবে না বলে মনে করেন তিনি।
জানা গেছে, ব্যাংকের ‘ভালো’ ঋণ গ্রহীতাদের প্রণোদনা দিতে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বিশেষ নীতিমালা জারি করেছিল। ওই নীতিমালা অনুযায়ী ভালো গ্রাহকরা প্রণোদনাগুলো পাচ্ছিল না। যে কারণে চলতি বছরের ১৬ই মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ওই নীতিমালা আরো সুনির্দিষ্ট করে এবং তাদের জন্য সুবিধা বাড়িয়ে নতুন নীতিমালা জারি করে। নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভালো গ্রাহকরা যাতে সব ধরনের সুবিধা পান সেগুলো নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এর পরও কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে।
ওই সার্কুলারে বলা হয়েছিল, ভালো ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে তাদের ঋণের বিপরীতে যে সুদ আদায় করা হবে তার ১০ শতাংশ রিবেট সুবিধা দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো গ্রাহকের কাছ থেকে ১০০ টাকা সুদ পাওনা হলে ৯০ টাকা আদায় করে ১০ টাকা ছাড় দিতে হবে। গ্রাহক ‘ভালো’ ঋণগ্রহীতা হলে প্রতি বছর এই সুবিধা অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজনে বর্ধিত ঋণ সুবিধাও পাবেন তিনি। ‘ভালো’ ঋণগ্রহীতা সুবিধা পাওয়ার জন্য ঋণগ্রহীতাদের আবেদন করতে হবে না। ব্যাংকগুলোকে নিজ উদ্যোগে তাদের চিহ্নিত করে প্রাপ্যতা অনুযায়ী প্রণোদনা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সার্কুলার জারি করে দেশে সব বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু ভালো গ্রাহকদের প্রণোদনার ব্যাপারে ব্যাংকগুলো কি ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানান তিনি।
যেসব প্রণোদনা: সার্কুলারে বলা হয়, চলমান/তলবি/মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাস শেষে বিগত ১২ মাসের (অর্থাৎ বিগত বছরের ১লা অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সব কিস্তি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে নিয়মিতভাবে পরিশোধিত হলে সেই ঋণগ্রহীতা ভালো ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবেন। এছাড়া ‘ভালো’ ঋণগ্রহীতাদের প্রতি বছর বিশেষ সনদ দিতে হবে ব্যাংকগুলোকে। সেরা ১০ ‘ভালো’ ঋণগ্রহীতার ছবিসহ তাদের ব্যবসা সফলতার সংক্ষিপ্ত চিত্র ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে হবে। ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী ভালো গ্রাহকদের বিশেষ সুবিধা (রিওয়ার্ড পয়েন্ট, ডিসকাউন্ট সুবিধা ইত্যাদি) প্রদান করতে হবে। এছাড়া কোনো গ্রাহক দীর্ঘ সময় ধরে ভালো ঋণগ্রহীতা থাকলে সেই গ্রাহকদের ছবি, প্রোফাইল ইত্যাদির সমন্বয়ে ব্যাংক থেকে বিশেষ বুকলেট বা ম্যাগাজিন প্রকাশ করতে হবে। ব্যাংকগুলো বার্ষিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভালো ঋণগ্রহীতাদের স্বীকৃতি বা পুরস্কার প্রদান করে তাদের সম্মাননা জানানোর ব্যবস্থা করতে পারে। ভালো গ্রাহকদের দেয়া রিবেট সংক্রান্ত তথ্য প্রতি হিসাববর্ষ শেষে পরবর্তী বছরের ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হবে। কিন্তু গত সাড়ে ৪ বছরেও এসব সুবিধার বাস্তবায়ন লক্ষ্য করা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এ পর্যন্ত যেসব নীতিমালা জারি করেছে তার সবই খেলাপিদের পক্ষে। এতে ভালো গ্রাহকদের জন্য কিছুই নেই। অথচ উচিত ছিল ভালো গ্রাকদের ভালোভাবে প্রটেকশন দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, সব আয়োজন ঋণখেলাপিদের ঘিরে। ভালো গ্রাহকদের পাশে তারা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের শুরুতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে ঋণ অবলোপন ৬০ হাজার কোটি টাকা ধরলে মোট খেলাপি দাঁড়ায় ৩ লাখ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এখন ঋণখেলাপিদের যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাতে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে। কারণ ভালো গ্রাহকরাও আর কিস্তি পরিশোধে আগ্রহ দেখাবে না। সরকারের ভুল নীতির কারণে খেলাপি ঋণ আরো বাড়তে পারে।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্যাংকিং খাতে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের লালন করতে হলে অবশ্যই ভালো গ্রাহকদের মূল্যায়ন করা উচিত। বিশেষ করে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন, ঋণখেলাপির খাতায় নাম নেই- এসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। তা না হলে কোনো ভালো ঋণগ্রহীতা আর ভালো থাকবেন না। কারণ তাদের মাথায় তখন এ চিন্তা কাজ করবে যে, ঋণখেলাপিরা যদি পদে পদে সুবিধা পান, সম্মানিত হন; তাহলে আমিও ঋণখেলাপি হলে দোষের কী!