× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নুড়িপাথরে মোড়া জীবন

এক্সক্লুসিভ

নূরেআলম জিকু, তেঁতুলিয়া থেকে ফিরে
২২ নভেম্বর ২০১৯, শুক্রবার

সালেহ উদ্দীন। বয়স ৫৫ বছর। ভোর রাতে আজানের শব্দে ঘুম ভাঙে তার। ফজরে নামাজ শেষ করে হাতে কাঁচি, লাঠি আর রাবারের টিউবসহ ২৭ জনের দল নিয়ে মহানন্দা নদীতে নামেন। সংগ্রহ করেন নুড়িপাথর। দলবদ্ধ হয়ে সবাই লাঠি ও কাঁচি দিয়ে নদীর বুক চিরে বের করে আনেন নুড়িপাথর। দিনশেষ কুড়ানো পাথর বিক্রি করে সন্ধ্যায় বাজার থেকে চাল, ডাল আর তেল নিয়ে বাসায় ফেরেন। সারাদিন পাথর তুলে আয় হয় ৪০০-৫০০ টাকা।
দেশের সর্বউত্তরের জেলা ও হিমালয়কন্যা খ্যাত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় এই মহানন্দা নদীর অবস্থান।

বছরের বেশিরভাগ সময় এই নদী থাকে পানিশূন্য। বিশেষ করে শীতের সময় নদী শুকিয়ে জেগে ওঠে বালুরাশি। সূর্যের আলোতে চারদিক চিকচিক করে সাদা বালু। সালেহ উদ্দিনের মতো প্রায় ১০-১২ হাজার মানুষের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস এই নদী। শীতের সময় ফসলের মাঠে আমন ধানের সমারোহ থাকলেও পানির মধ্যে থেকে বালি আর নুড়িপাথর তোলার কাজ ছাড়তে পারছেন না তারা। এখানকার শ্রমিকরা বংশপরম্পরায় নুড়িপাথর সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যাদের অধিকাংশ ভূমিহীন। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তঘেঁষা এ নদীর নুড়িপাথরের বিনিময়ে জুটছে তাদের সারা বছরের অন্নের সংস্থান। সরজমিনে দেখা যায়, হিমালয়ের কোল থেকে সৃষ্ট মহানন্দা নদী ভারতের ফুলবাড়ী হয়ে তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখানে আসে অসংখ্য নুড়িপাথর। পানি কমে গেলেই শ্রমিকরা দল বেঁধে পাথর তুলতে নেমে পড়েন। নদী পাড়ের বাংলাবান্ধা, ঝাড়ুয়াপাড়া, পুরাতন ভারত-বাংলাবাজার, জায়গীরজোত, পাগলিডাঙ্গীসহ আশেপাশের প্রায় অর্ধশত গ্রামের মানুষ যুগ যুগ ধরে এ নদী থেকে নুড়িপাথর তুলছেন।

সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার বিজিবি ও বিএসএফের কড়া পাহারার মধ্যে পাথর তুলতে হয় তাদের। পূর্বপুরুষদের অনুসরণে পাথর শ্রমিকরা নদী থেকে পাথর তুলে সংসারের ভরণপোষণ করছেন। শীতকালের ৬-৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপেক্ষা করে দিনভর চলে পাথর সংগ্রহের কাজ। বর্ষায় পানি বেড়ে গেলে পাথর তুলতে হিমশিম খেতে হয়। নুড়িপাথর শ্রমিক নজির মিয়া বলেন, পাথর তোলা ছাড়া কোনো কাজ তেমন পারি না। আর অন্য কাজে টাকা কম। সব সময় কাজ থাকে না। এখানে পাথর তোলার কাজ থাকে সব সময়। সারাদিন পাথর সংগ্রহ করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। এখানকার ব্যবসায়ীরা পাথরের সিএফটি ৩৫ থেকে ৪০ টাকা দরে কিনে নেন। তারা সেগুলোকে বেশি দরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন। আমরা সারাদিন পানিতে থেকেও পাথরের দাম পাই না। দিনে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পাই। তবে কপাল ভালো থাকলে বেশি পাথর তুলতে পারলে ৬০০-৭০০ টাকাও পাওয়া যায়। ঠাণ্ডা আর জ্বর নিয়েও পাথর তুলি। তবে কখনো কখনো বিজিবি আমাদের নদীতে নামতে দেয় না। শিশু শ্রমিক রাশেদ জানায়, বাবার সঙ্গে নদীতে নেমে পাথর তুলি। আগে স্কুলে যেতাম, এখন আর যেতে পারছি না। বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসে। আমরা দু’জনে দিনে ৭০০-৮০০ টাকার মতো পাই। এটা দিয়েই আমাদের সংসার চলে। স্থানীয় পাথর ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন বলেন, আমি গত ২২ বছর ধরে পাথরের ব্যবসা করে আসছি। শ্রমিকদের কাছ থেকে অল্প অল্প নুড়িপাথর কিনে রাখি। দাম ভালো হলে বিক্রি করি। আমার এ নুড়িপাথর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রাকভর্তি করে পাঠাই। নুড়িপাথরের ব্যবসা করে আমি ৩টি বড় ট্রাক কিনেছি। ছেলেমেয়েরা ঢাকায় পড়াশোনা করছে। এ কাজে অনেক কষ্ট আছে। ইচ্ছা করলেও ছাড়তে পারবো না।

বুড়াবুড়ি মণ্ডলপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, তেঁতুলিয়া উপজেলার অধিকাংশ মানুষ নুড়িপাথর সংগ্রহ ও পাথর ভাঙা পেশায় জড়িত। এখানকার মানুষ অভাব অনটনে দিন কাটায়। অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তারা সন্তানদের বেশি পড়াশোনা করাতে চায় না। একটু বড় হলেই তারা পাথর তোলা কিংবা ভাঙার কাজে লেগে যায়। তবে এলাকায় আগের চেয়ে বর্তমানে শিক্ষার হার বাড়ছে। সরকারের বিভিন্ন ফিডব্যাক কর্মসূচিতে স্কুলগুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর