তিনি শিক্ষা ভবনের টেন্ডার মুঘল। একক আধিপত্য বিস্তার করে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। গড়েছেন বিপুল অবৈধ সম্পদ। এই টেন্ডার মুঘলের নাম শফিকুল ইসলাম। দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ আসার পরই তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হয়। অনুসন্ধানে মেলে শফিকুল ইসলামের কোটি টাকার সম্পদের তথ্য। গতকাল এসব অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। সংস্থাটির ঢাকা সমন্বিত কার্যালয়-১-এ মামলাটি দায়ের হয় বলে জানান জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য।
সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, শফিকুল ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত তার আয়কর নথিতে মোট ৭ কোটি ১২ লাখ ৩৭ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ দেখালেও সংশ্লিষ্ট তথ্য বিশ্লেষণে দুদকের মনে হয়েছে, ওই সব সম্পদের অর্জন মূল্য অনেক বেশি। তদন্তের সময় এ বিষয়ে নিরপেক্ষ প্রকৌশলীর মতামতসহ অন্যান্য তথ্য পর্যালোচনা করা হবে। এসব সম্পদ অর্জনের পক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পায়নি দুদক। আয়কর নথিতে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ৮০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ দেখিয়েছেন শফিকুল।
কিন্তু এরও অর্জনের সপক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি। দুদক বলছে, শফিকুল অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের মালিকানা পেয়েছেন। দুদকের হিসাবে ১৪ কোটি ৪১ লাখ ১৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন শফিকুল। এজাহারে আরো বলা হয়, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য এবং বিভিন্ন গোপন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে শফিকুল ইসলাম অবৈধ উপায়ে বিভিন্ন নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ অর্জন করেছেন। ওই সম্পদসংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ-প্রক্রিয়া জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিধায় তদন্তের সময় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় তথ্য সংগ্রহ করা হবে। সঠিক তথ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে তার অর্জিত সম্পদের পরিমাণ অনেক বাড়বে। শফিকুল ইসলাম তার নিজ নামে বা স্ত্রী-সন্তান কিংবা অন্য কারও নামে আরও সম্পদ অর্জন করেছেন কি না, সে বিষয়েও তদন্তের সময় যাচাই করা হবে।
শফিকুল ইসলাম কেন্দ্রীয় যুবলীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ছাত্র জীবনেই বেশ বেপরোয়া ছিলেন তিনি।র্ শিক্ষাভবনে টেন্ডারবাজি করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই মারপিটের শিকার হন তিনি। ২০০০ সালে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি সাহিত্যের ছাত্র ও তৎকালীন মুহসীন হল ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন শফিকুল। গ্রেপ্তার অবস্থায় পত্রপত্রিকায় তার ছবি ছাপা হয়েছিল। জামিনে মুক্তি পেয়েও শুধরাননি শফিকুল। বরং আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শিক্ষাভবনে তখন যাতায়াত বেড়ে যায় শফিকুলের। দীর্ঘ সময়ে রাজনীতির মাঠের চিত্র বদলালেও বদলায়নি শফিকুলের চরিত্র। শিক্ষাভবনে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন আরো ব্যাপকভাবে। হয়ে যান ভবনটির টেন্ডার নিয়ন্ত্রকের প্রধান। যত টেন্ডার হবে শফিকুলের জানা থাকতে হবে। তাকে হিসাব দিতে হবে। সে সঙ্গে ভাগের অংশটাও শফিকুলের। সূত্র বলছে, নিজেকে একজন ঠিকাদার হিসেবে পরিচয় দিলেও সেটি তার মূল পেশা নয়। তার মূল পেশা টেন্ডারবাজি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট যেকোনো কাজ যিনি পান না কেন, প্রতিটি টেন্ডারে ৫ শতাংশ কমিশন দিতে হতো শফিককে। এর মাধ্যমেই মূলত তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তবে তার বিপুল অর্থ সম্পদের তথ্য দুদকের হাতে এলেও এখনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারেনি সংস্থাটি। সাড়ে ১৪ কোটি টাকার তথ্যপ্রমাণ পাওয়ায় সেসব তথ্যের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত গত ১৮ই সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন ঢাকার দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বেশ কজন প্রভাবশালী রাজনীতিক। সরকার ঘোষিত এই শুদ্ধি অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তাসহ অনেকের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদকও। গত ৩০শে সেপ্টেম্বর কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুরু হওয়া অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে তাদের বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য। সেই আলোকে এখন পর্যন্ত ১৬টি মামলা করে সংস্থাটি। ঠিকাদার শফিকুল ইসলামের আগে জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগের নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবির পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ ও এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ এবং যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তার স্ত্রী সুমি রহমান এবং কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করে দুদক।