× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাপ অনুভব করছে বাংলাদেশ

এক্সক্লুসিভ

জ্যাসন মিচেল
৪ ডিসেম্বর ২০১৯, বুধবার

বাছাই করা ২৬টি দেশের মধ্যে ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিস্তার ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। স্পেকটেটর ইনডেক্স-এর একটি হিসাব এ কথা বলছে। ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮৮ শতাংশ। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইথিওপিয়ার ১৮০ শতাংশ, চীনের ১৭৭ শতাংশ, ভারতের ১১৭ শতাংশ ও ইন্দোনেশিয়ার ৯০ শতাংশ। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন অর্থবছরে অর্থনীতি ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আগের অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮.১৩ শতাংশ।
অপরদিকে ভারতের প্রবৃদ্ধি ২০১৯ অর্থবছরে হবে ৬.৫ শতাংশ, চীনের ৬.২ শতাংশ। আইএমএফ বলছে, বিশ্বে শুধু ঘানা (৮.৭৯%) ও দক্ষিণ সুদানের (৮.৭৮%) অর্থনীতি বাংলাদেশের চেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আধিপত্য মূলত রাজধানী ঢাকার।
দেশের বেশির ভাগ শিল্প কারখানা, সরকারি ভবন, উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র ও উন্নতমানের স্বাস্থ্য স্থাপনা এ শহরেই অবস্থিত, যদিও ঢাকার আয়তন পুরো দেশের মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু দেশের জিডিপিতে ঢাকার অবদান ৩৬ শতাংশ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৪ শতাংশই ঢাকায়।

প্রবৃদ্ধির গল্প: ২০০৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যকার সময় হিসাব করলে গড়ে প্রতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে ৬.৪৫ শতাংশ হারে। বর্তমানে দেশটির অর্থনীতির আকার ৩১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রায় কলম্বিয়া ও ফিলিপাইনের সমান। দেশটির জনসংখ্যা ১৬.৬ কোটি। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ পেয়েছে ৩.১৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬৮ শতাংশ বেশি। তবে এই বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা মূলত ১টি চুক্তির। সেটি হলো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিগারেট নির্মাতা ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকোর বিক্রি। আজিজ গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠান ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনেছে জাপান টোব্যাকো।

গোল্ডম্যান স্যাকস বাংলাদেশকে ‘নেক্সট ইলেভেন’ভুক্ত দেশগুলোর একটি হিসেবে বিবেচনা করছে। এই দেশগুলো শিগগিরই বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির অন্যতম হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ছাড়া তালিকার অন্য দেশগুলো হলো মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক ও ভিয়েতনাম।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের (বিডা) পরিচালক শাহ মোহাম্মদ মাহবুব বলেন, ‘বাংলাদেশ হলো সুযোগের দেশ। যেসব বিদেশি কোম্পানি এখানে বিনিয়োগ করেছে তারা আকর্ষণীয় মুনাফা অর্জন করেছে। গত ৩০ বছরে একবারও দেশটির প্রবৃদ্ধির ধারা নেতিবাচক ছিল না।’ বিডা বলছে, বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতিনির্ভর একটি প্রাণবন্ত ও সৃজনশীল বেসরকারি খাত রয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।

বিনিয়োগ আকর্ষণ: ২০২০ সালের শেষ নাগাদ নিম্ন-মধ্যম ও ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের যে কৌশল বাংলাদেশ নিয়েছে, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো দেশজুড়ে শতাধিক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা। ইতিমধ্যেই সেখানে অনেক জাপানি কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে সুমিতোমো, সোজিতস, নিপন স্টিল, শিনওয়া ও মারুহিসা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, দেশের সাধারণ মুদ্রাস্ফীতির হার জুনে আগের মাস ও আগের বছরের জুন মাসের চেয়ে কমেছে। এডিবি বলছে, দেশের আর্থিক ঘাটতির হার ৫ শতাংশের কিছুটা কম। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রয়েছে ৩৩০০ ডলার মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

২০১৮ সালের জুনে বাংলাদেশ সফর করেছিল আইএমএফ’র একটি দল। দলনেতা দাইসাকু কিহারা বলেন, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ব্যক্তি খাতে ব্যাপক ব্যয়ের কারণেই ২০১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৮ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। তবে মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে, যা মূলত খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও সম্প্রতি আগের অবস্থানে পৌঁছেছে, যার কৃতিত্ব তৈরি পোশাক খাতের।

ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা: বিশ্বব্যাংকের ডুইং বিজনেস ২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থান ১৯০টি দেশের মধ্যে ১৭৬তম। আগের বছর যা ছিল ১৭৭ তম। তবে এ বছর বাংলাদেশ ৮ ধাপ এগিয়ে ১৬৭তম। ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী আলি রেজা ইফতেখার বলেন, ব্যবসা সহজীকরণ সূচকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নতি করতে বাংলাদেশের সর্বব্যাপী প্রচেষ্টা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তরিত করতে হলে এই সূচকে উন্নয়ন জরুরি।

তিনি আরো বলেন, দেশের মোট রপ্তানির ৭৫ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। বাংলাদেশের জন্য ৫টি জিনিস খুবই জরুরি এই মুহূর্তে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা অব্যাহত রাখা, ভালো ঋণ ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ভালো আঞ্চলিক যোগাযোগ।
যানজট ও দূষণ: তবে উচ্চ প্রবৃদ্ধির মূল্যও চড়া। বায়ু মানের দিক থেকে বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ঢাকার। বায়ুদূষণের মূল উৎস মূলত ইটের কণা, অত্যধিক সালফার রয়েছে এমন জ্বালানি ব্যবহারকারী যানের আধিক্য ও প্রচুর নির্মাণকাজ।

১.৮ কোটি জনসংখ্যা ও প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭,৪০০ মানুষ যে শহরে বসবাস করে, সেই ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবহুল শহর। সরকার অনুমান করছে, প্রতিদিন গড়ে দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ১৪০০ মানুষ এসে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন।

ঢাকার যানজটের অবস্থা এত খারাপ যে, ২০০৮ সালে যেখানে প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গড় গতিবেগ ছিল ২১ কিলোমিটার, তা এখন ৭ কিলোমিটার। ২০৩৫ সাল নাগাদ এটি ঘণ্টা প্রতি ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে, যা হাঁটার গতির চেয়েও কম। সরকারের হিসাব মতে, ২০১৬ সালেই কেবল ২০,৩০৪টি নতুন গাড়ি নেমেছে রাস্তায়। অর্থাৎ প্রতিদিন সড়কে নামছে ৫৫টি নতুন গাড়ি।

যানজট নিরসনে সরকার দীর্ঘমেয়াদি অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রিংরোড, ৫টি মেট্রো রেললাইন, ২টি র‌্যাপিড বাস রুট, ১২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন সড়ক ইত্যাদি। ২০১৮ সালের ১লা এপ্রিল থেকে বহুল আলোচিত ৪৭ কি.মি. দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের মোট খরচ প্রায় ১৬০ কোটি ডলার। এ ছাড়া সরকার ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও বিভিন্ন সেবার লাইন পরিবর্তনে ৫৮ কোটি ডলার খরচ করছে।

তবে বুয়েট অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, আগে ঢাকায় অভিবাসনকে অনুৎসাহিত করতে হবে। এরপর এখন যারা বসবাস করছে তাদের এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন জীবনচক্র থেমে না যায়। কিন্তু এই ধরনের কোনো নীতি আমরা এখনো চালু করতে পারিনি।

শহুরে অভিবাসন: শামসুল হক বলেন, শহুরে অভিবাসন প্রতিরোধে সমন্বিত পরিবহন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা সিস্টেম সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘অব্যবস্থাপনার কারণে বিভিন্ন উন্নয়ন সুবিধা থেকে আমরা বঞ্চিত হবো। ঢাকা ইতিমধ্যেই ব্ল্যাকহোলে রূপ নিয়েছে। এরপর এটি নিজেই নিজের ভেতর বিলীন হয়ে যাবে। যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানুষ ভালো স্কুল, হাসপাতাল ও অন্যান্য সুবিধা পায়, তাহলে এই বড় শহরে আসার ইচ্ছা আর কাজ করবে না।’

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বন্যা এখানে স্বাভাবিক একটি বিষয়। তবে শহুরে এলাকা ঘন ঘন প্লাবিত হচ্ছে দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে। ঢাকা শহরে অন্তত ১৪০০ হেক্টর জলাভূমি ও নিচু এলাকা দখল হয়েছে এই নয় বছরে। ফলে এই সমস্যা যেন চিরস্থায়ী হয়ে উঠছে। আগে যেখানে ৬৫টি খাল ছিল এই শহরে, এখন সেখানে মাত্র ২৬টি। সেগুলোও এখন আবর্জনা ফেলার স্থানে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পানি, খাল ও নদী ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে ৭টি ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা। ফলে কৌশলগত পরিকল্পনা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশের উচ্চগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশ চমকপ্রদ। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সঙ্গে হাজির হয়েছে বেশকিছু জরুরি চ্যালেঞ্জও।

(জ্যাসন মিচেলের এই প্রতিবেদন যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর সহযোগী প্রকাশনা দ্য ব্যাংকার-এ প্রকাশিত হয়েছে)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর