সিলেটেও নতুন নেতৃত্বই খুঁজে নিলো আওয়ামী লীগ। সিটি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধই শেষ পর্যন্ত কাল হলো নেতাদের জন্য। নেতৃত্ব থেকে বাদ পড়লেন মহানগর সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান, জেলার সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ। গতকাল দিনব্যাপী সম্মেলনের পর বিকালে ২০ মিনিটের সময় চেয়ে নেন ওবায়দুল কাদের। চলে যান মঞ্চ ছেড়ে। ফিরে এসে ঘোষণা করেন নতুন নেতৃত্বের নাম। জেলা আওয়ামী লীগের ভারমুক্ত হয়ে নতুন সভাপতি হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুরব্বি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমান। চমক আসলো জেলা সাধারন সম্পাদক নির্বাচনে।
তরুনদের মধ্য থেকে চমক দেখিয়ে সাধারণ সম্পাদক হলেন নাসির উদ্দিন খান। আর মহানগরে হলো দুটি পদেই পরিবর্তন। নতুন সভাপতি হলেন- মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান- আওয়ামী লীগ কাউকে বাদ দেয় না। নেতৃত্বের পরিবর্তন করে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের কারণেই এই পরিবর্তন। আগামী তিন বছর ঘোষিত নেতৃত্ব সিলেট আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব দেবেন বলে জানান তিনি। এদিকে- কমিটি ঘোষণার পরপরই কেন্দ্রীয় নেতারা নতুনদের গলায় মালা পরিয়ে বরণ করে নেন। বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খানের সমর্থকরা মাদ্রাসা মাঠজুড়ে আনন্দ উল্লাস করেন।
সিলেটে নেতৃত্বে বার বার চমক দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০১১ সালে একইভাবে চমক ছিলো। একমাত্র কামরান ছাড়া বাকি তিনজনই ছিলেন নতুন। এবারও তাই হয়েছে। এবারের কমিটি থেকে বাদ পড়লেও সিলেটের সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান কেন্দ্রীয় সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন। সিলেট আওয়ামী লীগের কয়েকজন সিনিয়র নেতা গতকাল রাতে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সন্ধ্যায় সিলেট ছাড়ার প্রাক্কালে দলের সাধারণ সম্পাদক সিলেটের বাদ পড়া নেতাদের মধ্যে দু’একজনকে নতুন করে শুরু করার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। সামনেই কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনে সিলেট থেকে এবার নতুন চমক থাকতে পারে বলে জানান তারা। এদিকে- সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদটি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে এ পদে জাদরেল নেতারা দায়িত্ব পালন করে গেছেন। সর্বশেষ সভাপতি ছিলেন প্রয়াত নেতা আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান। তিনি মারা গেলে প্রায় ৪ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন এডভোকেট লুৎফুর রহমান। এবার তিনি ভারমুক্ত হলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণেই তিনি এ পদটি অলঙ্কৃত করলেন। আর জেলা সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান ছিলেন সাবেক কমিটির যুগ্ন সম্পাদক। এর আগে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
ছিলেন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদকও। নতুন সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর নাসির উদ্দিন খান দলীয় প্রধান সহ সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। বলেন- দলীয় সভানেত্রী তার উপর যে আস্থা রেখেছেন তিনি আগামী দিনে সেই আস্থার প্রতিদান দেবেন। বিশেষ করে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগে নতুন গতির সঞ্চার করতে কাজ করবেন বলে জানান। মহানগর নতুন সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ কখনোই মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। জেলার সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। তাকে মহানগরের সভাপতি করা হয়েছে। মাসুক উদ্দিন আহমদ পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য সিলেট-৫ আসন থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তার ছোটো ভাই আসাদ উদ্দিন আহমদ ছিলেন মহানগরের সাধারণ সম্পাদক। এবার নিজ ঘরেই ঘটে গেলো রাজনীতির ট্র্যাজেডি। বাদ পড়লেন আসাদ। আর চমকে দিয়ে সভাপতি হলেন মাসুক। মহানগরের সভাপতির মতো সাধারণ সম্পাদকও নতুন। গত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি কখনোই আলোচনায় ছিলেন না। তবে- সৎ হিসেবে তিনি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
যে কারণে নেতৃত্বে পরিবর্তন : সিলেট জেলা আওয়ামী লীগে নিবেদিত প্রাণ নেতা হিসেবে শফিকুর রহমান চৌধুরী পরিচিত। এবার তিনি হয় সভাপতি না হয় সাধারণ সম্পাদক- দুটি থেকে একটিতে থাকবেন এমন ধারণা ছিলো খোদ নেতাদেরও। কিন্তু দুর্বল নেতৃত্ব শফিকুর রহমান চৌধুরীর জন্য কাল হলো। নিজে ২৪ ঘণ্টা রাজনীতি করেন। তবে অর্জন নিয়ে প্রশ্ন অনেক। কারন- কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে জেলার যে বর্ধিত সভা হয়েছিলো সেখানে উপজেলা আওয়ামী লীগগুলোতে নেতৃত্বের কোন্দলের বিষয়টি প্রকাশ পায়। সাংগঠনিক রিপোর্ট নিয়ে অদক্ষতার বিষয়টি আলোচিত হয়। নিজ এলাকা বিশ্বনাথের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক মাইক নিয়ে টানাটানি করেন। এতে করে বিতর্কিত হয়ে পড়েন শফিকুর রহমান চৌধুরী। কেন্দ্রীয় নেতারা তার উপর নাখোশ হন। এর বাইরে নিজ এলাকায় তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষ রয়েছে। রাজনীতির গুণ দিয়ে তিনি প্রতিপক্ষদের কাছে টানতে পারেননি। এ কারণে গতকাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে বাদ পড়ার পর শফিকুর রহমান চৌধুরীকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি। তবে- ত্যাগী নেতা হিসেবে তাকে মানেন সবাই। সিলেট-২ আসনে তিনি জোটের জন্য ছাড় দিয়েছিলেন। শুধু ছাড়ই দেননি, তিনি জোটের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে সক্রিয় ছিলেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সমমনাদের সঙ্গে সদভাব বজায় রেখে চলেছেন তিনি। সিটি নির্বাচনের নৌকার প্রার্থী বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের পরাজয়ই কাল হলো সিলেট নগর আওয়ামী লীগের জন্য। দেশের সব সিটি নির্বাচনের নৌকার জিতলেও সিলেটে হেরেছে।
যোগ্য প্রার্থী কামরান থাকার পরও জয় হলো না নৌকার। এই পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিলো নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা। নৌকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অনেকেই। ফল স্বরূপ তারা কেন্দ্রের শোকজপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। ‘বলির পাঠা’ কামরানকে নিয়ে সিলেট আওয়ামী লীগেও এবারের সম্মেলনেও নাটকীয়তার কমতি ছিলো না। আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন- কোন্দলের কারনেই সিলেট সিটিতে জয় ঘরে তোলা সম্ভব হয়নি- সেটি প্রমাণিত বিষয়। এই কোন্দল মেটাতে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়েছে। আশা করি- নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে সিলেট নগর ভবন পুনরুদ্ধার হতে পারে।
ব্যর্থতার দায় আমি কাঁধে তুলে নিলাম- কামরান : মহানগর আওয়ামী লীগের সকল ব্যর্থতার দায় আমি কাঁধে তুলে নিলাম। তবুও আপনাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কোনদিনই শোধ হবার নয়। বৃহস্পতিবার সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে একথা বলেন তিনি। বদর উদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, দেশের মধ্যে অশুভ শক্তি সব সময়ই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। মহানগর সভাপতি হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি আমার সহকর্মী ইব্রাহিমকে হারিয়েছি। ১৮ মাস জেল খেটেছি। কুমিল্লা কারাগারে থাকা অবস্থায় আমি আমার মাকে হারিয়েছি। দায়িত্ব পালনের সকল সফলতা আপনাদের, সকল ব্যর্থতা আমি কাঁদে তুলে নিলাম।