× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার , ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

কারখানায় আগুনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩ /শোকের মাতম

প্রথম পাতা

স্টাফ রিপোর্টার
১৩ ডিসেম্বর ২০১৯, শুক্রবার

দুপুর সাড়ে ১২টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সামনে একটি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দুর্জয় দাসকে। কিশোর দুর্জয়ের বয়স মাত্র ১৩ বছর। ঘটনার দিন সে কাজে যেতে চায়নি। মা জোর করে তাকে ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়েছিলেন। এখন সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। দুর্জয়ের বড় বোনের কান্নায় হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠেছে। এদিকে মর্গের সামনে স্বামী ও ভাসুরের লাশ নিয়ে বসে আছেন রুমা।
যেন কান্না করতে ভুলে গেছেন। শোকে পাথর হয়ে গেছেন নিঃসন্তান রুমা। বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় আইসিইউ’র সামনে বসে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বিলাপ করছেন ফয়সালের মা ফাতেমা। কেরাণীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছেন স্বজন হারানো পরিবারগুলো। যারা বেঁচে আছেন তাদের অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন। অসহায় পরিবারগুলো জানে না কি হবে তাদের ভবিষ্যৎ। দুর্জয়ের বন্ধু সজিব বলেন, ঘটনার দিন দুর্জয়ের শরীর খারাপ ছিল। সে তার মাকে জানায় কাজে যাবে না। এসময় দুর্জয়ের মা ছেলেকে বুঝিয়ে বলেন, আজ কাজে না গেলে বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক টাকা পাবে না। অবশেষে মায়ের কথায় সে ফ্যাক্টরিতে কাজে যায়। গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্ফোরণের পরে সে পেছন দিক দিয়ে একটি পানির ডোবায় লাফিয়ে পড়ে। ডোবা থেকে উঠে দৌঁড়াতে থাকে। গলির মোড়ে এসে সবাইকে বলতে থাকে আমার কি হয়েছে দেখ।

এসময় দুর্জয়ের শরীর থেকে পোড়া মাংসগুলো খসে পরছিল। সেখান থেকে দৌঁড়ে বাসায় যায়। মা’কে বলে, আম্মু আমি ভয় পাচ্ছি। আমার কি হয়েছে। দগ্ধ দুর্জয় দাসের বোন নয়ন তারা বলেন, হাসপাতালের লোকজন যখন বলেছে আমার ভাই বাঁচবে না। তখন তাকে হাসপাতালে রেখে কি হবে। ভাইও বুঝতে পেরেছে সে বাঁচবে না। তাই তাকে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের বাসায় নিয়ে যেতে বলছে। মরলে বাসায় গিয়ে মরবে। তাই ভাইকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। ওয়ার্ডের লোকজন বলাবলি করেছে ভাই বাঁচবে না। তার শরীরের ১০০ ভাগ পুড়ে গেছে। এখন ভগবান যা করে। দগ্ধ দুর্জয় দাসের বাড়ি দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কদমতলী এলাকায়। সে প্লাস্টিক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করত। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে ছোট। তার বাবা মিন্টু দাস লেগুনা চালক। নিহত আলমের স্ত্রী রুমা বলেন, আমাদের বিয়ে হয়েছে ৮ বছর। কোনো ছেলে মেয়ে নেই। স্বামী আলমের বয়স ৩৫ বছর। সাত ভাই বোনের মধ্যে সে পঞ্চম। তাদের গ্রামের বাড়ি সিরাজদিখান। ঘটনার দিন আলম সকালে বাজার করে আমাকে বলেন, যেন ফুলকপি আর তেলাপিয়া মাছ দিয়ে রান্না করা হয়। রাতে এসে খাবেন। আগুন লাগার পরে সে দগ্ধ অবস্থায় দৌঁড়ে বাসায় আসে। আমাকে বলতে থাকে রুমা আমাকে বাঁচাও। এসময় রুমা স্বামীর গায়ে পানি ঢালতে থাকেন। হাসপাতালে মারা যাওয়ার আগে স্ত্রীকে বলেন, আমি যদি আর সুস্থ না হই। তাহলে তুমি কি আমাকে কাজ করে খাওয়াবে। আমি মনে হয় আর সুস্থ হব না। রাজ্জাক ও আলম দুই ভাই। বড় ভাই রাজ্জাক মারা যান সকাল সাড়ে ৬টায়। ছোট ভাই আলম মারা যান দুপুর ১টায়। নিহত রাজ্জাকের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া একটি মেয়ে রয়েছে।

ফয়সালের মা ফাতেমা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বলেন, আমার একটি মাত্র ছেলে। আল্লাহ তাকে নিয়ে গেল। ছেলেকে মাত্র এক বছর আগে বিয়ে করিয়েছি। ছেলের বউ তাসলিমা পাঁচ মাসের অন্ত:সত্ত্বা। সে এখনো জানে না যে ফয়সাল বেঁচে নেই। ফয়সালের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের উত্তর রায়পুর। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কেরাণীগঞ্জে থাকতেন। সকাল পৌনে ১১টায় মারা যান।

ফয়সালের বোন জামাই রিপন বলেন, মারা যাওয়ার আগে আমাকে বলেছে ভাইয়া আমি বাঁচবো না। আমার কষ্ট হচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বাড়ি করেছে। এখন পর্যন্ত সেই লোন সোধ হয়নি। সে ফ্যাক্টরির ইলেকট্রিক মেকানিক ছিলো। গত দুই বছর ধরে সে এখানে চাকরি করছে।       

নিহত বাবুলের ভাই আমির হোসেন বলেন, ঊর্ধতন বসকে বাঁচাতে গিয়ে আমার ভাই মারা গেছে। ভাইয়ের বয়স মাত্র ২৬ বছর। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে। গত মাসের ৫ তারিখ ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজে যোগ দেয়। বাবার নাম তোফাজ্জল হোসেন। গ্রামের বাড়ি নরসিংদি। আগুন লাগার পরে সে তার বসকে বাঁচাতে আগুনের মধ্যে ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় তারা দুজনই দগ্ধ হয়। হাসপাতালে পাশাপাশি বেডে তারা ছিল। ভাই মারা যাওয়ার আগে বারবার আমাকে বলেছে, ভাই আমার বসকে একটু গরম পানি হলেও খাওয়া। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বস মারা যাওয়ার পরই ভাই মারা যায়। এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, অগ্নিকাণ্ডের এ ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের এইচডিইউতে ৮ জন ভর্তি রয়েছেন। শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে ভর্তি আছেন ১০ জন। ঢাকা মেডিকেলে এ পর্যন্ত মোট ৩১ জন দগ্ধ রোগী এসেছেন। তাদের মধ্যে ১১ জন মারা গেছেন।

শেখ হাসিনা বার্নে দুই জন মারা গেছেন। একজন ডিসচার্জ নিয়ে বাসায় চলে গেছে। প্রত্যেক রোগীই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সবার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। চাকরি জীবনে এভাবে শতভাগ বার্ন আমি কখনো দেখিনি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে মুঠোফোনে খুদে বার্তায় নিহতদের বিষয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। দগ্ধদের সমস্ত খরচ ও চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করবে। এদিকে গতকাল আহতদের দেখতে হাসপাতালে যান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি আহতদের চিকিৎসায় সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এদিকে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অ্যাম্বুলেন্স শাখার উপ-পরিচালক আবুল হোসেনকে প্রধান করে চার সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং কলকারাখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক (সেফটি) মো. কামরুল হাসানকে সদস্য সচিব করে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

স্বজনদের আহাজারিতে ভারি প্লাস্টিক কারখানা এলাকা
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা) প্রতিনিধি জানান, কেরানীগঞ্জে ভস্মীভূত প্রাইম প্লাস্টিক কারখানা এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আহত ও নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এ সময় এলাকায় আবেগময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। কারখানা ধ্বংসস্তূপ দেখার জন্য উৎসুক জনতা ঘটনাস্থলে ভিড় জমায়। কারখানাটি পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। এদিকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম দুপুর ১২টায় ভস্মীভূত কারখানাটি পরিদর্শন করেছেন। তিনি বলেন- যারা এই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সবাইকে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে। কারখানাটি নন-কমপ্লান্স থাকায় ইতিমধ্যে মালিকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। এই ঘটনায় একই মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালালকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সাইফুল ইসলাম, উপ-মহাপরিদর্শক সেফটি কামরুল ইসলাম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক শিবনাথ রায়। কমিটি তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে  তদন্ত কমিটির প্রধান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল দুপুর সাড়ে ১২টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, আমি ও এই কমিটির অন্য সদস্যরা আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল করবো। এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (এম্বুলেন্স) আবুল হোসেনের নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির অন্য সদস্যরা হলো ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মোমিন, উপ-সহকারী পরিচালক মো. মোস্তফা মহসীন, সিনিয়র স্টেশন অফিসার সাইফুল ইসলাম (কেরানীগঞ্জ)।

ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হোসেন বলেন, কারখানা যেভাবে ও যে পরিবেশে চলার কথা তার কোনো কিছুই এখানে পাওয়া যায়নি। এধরনের কারখানা আবাসিক এলাকায় না থাকাই উত্তম। অন্যদিকে তদন্ত কমিটি ভস্মীভূত কারখানা পরিদর্শনে আসলেও কারখানাটির মালিক বা শ্রমিকদের কাউকে উপস্থিত পায়নি। এ ছাড়া  শুভাড্ডা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী ইকবাল হোসেন সকালে ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও তাদের স্বজনদের ক্ষতিপূরণ সহ চিকিৎসার আশ্বাস দেন। এ ছাড়া তিনি এই কারখানাসহ সকল ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা আবাসিক এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার দ্রুত ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। কারখানার পাশের বাড়ির রোকেয়া বেগম জানান, আমার দুই ভাই এই কারখানায় কাজ করতো। তারা দুজনেই আগুনে দগ্ধ হয়। ইতিমধ্যে আলমগীর মারা গেছেন।

অপর ভাই রাজ্জাকের অবস্থাও মুমূর্ষু। আমরা সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাই। এই কারখানা যেন আমাদের আবাসিক এলাকায় আর থাকতে না পারে সেজন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাই। কারখানার সিকিউরিটি সুপারভাইজার শাকিল জানান, গ্যাস লিকেজ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়। দ্রুত কারখানায় রাখা গ্যাস সিলিন্ডারগুলো  কারখানা থেকে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দ্রুতগতিতে আগুন কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। এসময় কারখানার  কর্মরত শ্রমিকরা দৌড়াদৌড়ি করে পালানোর সময় তাদের বেশির ভাগ আগুনে ঝলসে গিয়ে গুরুতর আহত হয়। এলাকাবাসী ডা. সেলিম জানান, এই কারখানাসহ অন্যান্য কারখানা আর আমাদের আবাসিক এলাকায় দেখতে চাই না। খুব দ্রুত সেগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর