পাইল্স সমস্যা সার্বজনীন, বাংলাদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কম বেশি প্রায় সবাই পাইল্স সমস্যায় সমূহ ভোগান্তির সম্মুখীন হন। পাইলসের রোগীরা পায়ুপথ দিয়ে রক্তক্ষরণ, পায়ুপথ ফুলে যাওয়া, ব্যথা অনুভব করা, পায়ুপথ দিয়ে পাইল্স বেরিয়ে আসা, মলদ্বারের চারপাশে চুলকানো বিভিন্ন উপসর্গে পীড়িত হন। উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হলে অথবা অনেক সময়ে উপসর্গগুলো ত্বরিতভাবে মারাত্মক আকার ধারণ করলে উৎপত্ব জটিলতা রোগীর জীবনে হমকির সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে এবং যেহেতু পাইল্সের উপসর্গ কোলন অথবা রেক্টাল ক্যান্সারের উপসর্গ অনেক সময় একই রকম হতে পারে পাইল্স উপসর্গ সম্পর্কে জনসাধারণের সক্রিয় সচেনতা অবশ্য প্রয়োজনীয়।
পাইল্স পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে কিনা তার উপর নির্ভর করে পাইল্সকে চার মাত্রায় বিভক্ত করা হয়ে থাকে এবং পাইল্স চিকিৎসা বহুলাংশে এই মাত্রা বিভেদের উপর নির্ভরশীল। পায়ুপথে শুধুমাত্র রক্তক্ষরণ প্রথম ডিগ্রি/মাত্রা পাইল্সের বৈশিষ্ট, এই মাত্রার পাইল্স কখনই পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে না। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মাত্রা পাইল্স পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসে মল ত্যাগ করার সময়ে কিন্তু মল ত্যাগ সম্পন্নের পর দ্বিতীয় মাত্রার ক্ষেত্রে নিজ হতেই মলদ্বারের ভেতরে চলে যায় এবং তৃতীয় মাত্রা পাইল্সের ক্ষেত্রে রোগীকে অঙ্গুলি দ্বারা চাপ দিয়ে পুনরায় মলদ্বারের ভেতরে প্রতিস্থাপন করতে হয়। চতুর্থ মাত্রার পাইল্স সবসময়ই পায়ুপথের বাইরে অবস্থান করে।
প্রথম মাত্রা এবং প্রথমাবস্থায় দ্বিতীয় মাত্রা পাইল্স চিকিৎসা: -ইঞ্জেকশন ও ব্যান্ড লাইগেশানের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়ে থাকে।
-সেই সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা পদ্ধতি পরিবর্তন করে নরম কিন্তু শক্ত অথবা পাতলা নয় এমন মল ত্যাগ করার অভ্যাস করা।
উপরোক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে প্রথম মাত্রা এবং প্রথমাবস্থায় দ্বিতীয় মাত্রা পাইলসের চিকিৎসা সম্ভব হতে পারে।
অগ্রবর্তী দ্বিতীয় মাত্রা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ মাত্রা পাইল্স চিকিৎসা: -এই মাত্রার পাইল্স শুধুমাত্র শল্যচিকিৎসায় অপারেশনের মাধ্যমেই আরোগ্য করা সম্ভব হয়।
যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের শল্য চিকিৎসকদ্বয় মিলিগান এবং মরগান ১৯৩৭ সালে এ ধরনের পাইলসের জন্য পায়ুপথের তিন অবস্থানে চর্মসহ অভ্যন্তরীণ অংশ কেটে ফেলে রোগীর আরোগ্য করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এ অপারেশনের পর প্রচুর ব্যথা হয়, বিশেষভাবে মলত্যাগের পর, ঘা শুকাতে দেড় হতে দু’মাস সময় লাগে, ঘন ঘন মলত্যাগ, এবং অনেকক্ষেত্রে মলত্যাগের অনুভূতি এলেই দ্রুতভাবে টইলেটের দিকে ধাবিত হতে হয়। মলত্যাগের পর মনে হয় যে মলাশয় মলমুক্ত হয়নি এবং আবারও মলত্যাগের অনুভূতি অনুভব করা যায়। অনেক সময়ে অপারেশনের পর দেড় হতে দু’মাসের পূর্বে কাজে ফিরে যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং পরিবার আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অপারেশনের জটিলতায় মলদ্বার সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে অথবা মল আটকে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে জীবনযাত্রা দুর্বিষহ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে।
১৯৯৩ সালে ইতালির প্যালেরমো বিশ্ববিদ্যালয়ের শল্যবিভাগের অধ্যাপক ডা. এন্টোনিও লংগো নুতন পদ্ধতির মাধ্যমে মলদ্বারে ক্ষত না করে, চর্ম অথবা মাংস না কেটে পাইলসের অত্যাধুনিক অপারেশন আবিষ্কার করেন। এই অত্যাধুনিক পদ্ধতি ‘স্ট্যাপলেড হেমোরহাইডেক্টটমি’ অথবা ‘স্ট্যাপলেড হেমোরহাইডোপেক্সি’ নামকরণে ভূষিত। এটি একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি যা অস্বাভাবিকভাবে বর্ধিত হিমোরোডিয়াল (পাইল্স) টিস্যু অপসারণ করে, তারপরে অবশিষ্ট হেমোরোডিয়াল (পাইল্স) টিস্যুকে তার স্বাভাবিক শারীরিক অবস্থানে ফিরিয়ে আনে। এতে করে পাইল্সের স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরে আসে এবং রোগী উপসর্গমুক্ত হয়। অধ্যাপক ডা. এন্টোনিও লংগো বিশ্বাস করেন যে পায়ুপথ হতে বেরিয়ে আসা পাইল্সকে ঝুলেপড়া মাংসপিণ্ডের সঙ্গে তুলনা চলে। কোষ্ঠকাঠিন্য, গর্ভাবস্থা এবং অন্যান্য কারণে উপর্যুপরি আঘাতে পাইল্সের পরিপোষক বন্ধনীগুলি দুর্বল হতে শুরু করে সঙ্গে সঙ্গে পাইলসগুলিও ঝুলে পড়তে থাকে। তখন সামান্য ঘর্ষণে পাইল্সের মধ্যকার শিরা হতে রক্ত ঝরা শুরু হয়, যে রক্তের পরিমাণ অল্প হতে প্রচুর হওয়া অস্বাভাবিক নয়। প্রফেসর লংগো যে পদ্ধতি ব্যবহারে সাফল্য অর্জন করেছেন সে পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ঝুলেপড়া পাইল্সকে পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া এবং পাইল্সের রক্ত সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে ফুলে যাওয়া রক্ত নালীগুলিকে শুকিয়ে দেয়া হয়। পাইল্সের স্বাভাবিক কার্যকলাপ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং রোগী উপসর্গমুক্ত হয়। যে অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে অপারেশান করা হয় সে যন্ত্র মলদ্বারের বাইরে কোন কাটাছেঁড়া করে না কিন্তু মলদ্বারের ভিতরে পায়ুপথ হতে প্রায় দেড় ইঞ্চি উপরে একটা অংশ চক্রাকারে কেটে নিয়ে আসে এবং একই সঙ্গে কাটা জায়গার প্রান্ত টাইটেনিয়াম দ্বারা তৈরি সূক্ষ্ম স্টেপেল দিয়ে জোড়া দেয়া হয়। যে স্থানে কাটা ও জোড়া দেয়া হয় সেখানে ব্যথার স্নায়ু/পেইন ফাইবার থাকে না, যার ফলে অপারেশনের পর রোগী ব্যথাহীন থাকে অথবা যৎসামান্য ব্যথা অনুভূত হয়, ঘা শুকানর প্রশ্ন আসে না এবং রোগী দ্রুত কাজে ফিরে যেতে পারে। অপারেশানের পর রোগী পশ্চিমা দেশগুলোতে একই দিনে বাড়ি চলে যেতে পারে। আমি আমাদের রাহেটিড স্পেশালাইজড হাসপাতালে রোগীর সুবিধার্থে এক বা দু’দিন হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করি।