চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত পুরো বিশ্ব। ভাইরাসটির খবর প্রকাশের পরপরই সেদেশ থেকে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া শুরু করে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার। নাগরিকদের সুরক্ষার কথা বিবেচনায় তাদের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে বিমান, হেলিকপ্টার মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ভারত, বাংলাদেশ সহ বহু দেশ। কিন্তু ব্যতিক্রম দেখা গেছে পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল উহান থেকেও নাগরিকদের সরিয়ে নেয়নি তারা। ৮০০ শিক্ষার্থীকে সেখানেই অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রশাসন।
বিদেশি সহপাঠীদের দলে দলে উহান ছাড়তে দেখেছে সেখানে পড়ুয়া পাকিস্তানি শিক্ষার্থীরা। কিন্তু নিজেরা আটকে রয়েছে ভাইরাসে জর্জরিত উহানে।
যেখানে প্রতিদিন ভাইরাসটির সংক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন কয়েক ডজন মানুষ। এখন পর্যন্ত কেবল চীনেই করোনার সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজারের বেশি মানুষ। আক্রান্ত হয়েছেন ৪২ হাজারের বেশি। এতকিছু সত্ত্বেও নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে না পাকিস্তান সরকার।
ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাদ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, পাকিস্তান সরকারের এমন অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তের জন্য দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর অবস্থাকে দায়ী করেছে। এক প্রতিবেদনে বলেছে, চরম দুর্দশায় ভুগছে পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। সেখানকার হাসপাতালগুলোয় নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। রয়েছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি। এর মাঝে যদি আক্রান্ত ব্যক্তিরা দেশে ফিরে আসেন তাহলে ভাইরাসটি পুরো দেশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে গুটিকয়েক পোলিও, ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলাকারী দেশের মধ্যে একটি পাকিস্তান। সম্প্রতি সেখানে বাড়ছে এইচআইভি আক্রান্তের সংখ্যাও।
উহানে পড়ুয়া পাকিস্তানি শিক্ষার্থী নাদিম ভাট্টি নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, বিশ্বাস করুন, প্রথমে আমিও ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কথা বিবেচনা করে ফেরত যেতে চেয়েছিলাম। চিন্তায় কয়েক রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু এখন আমরা দেশে ফিরে না যাওয়ার কথাই ভাবছি। দেশে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা করার মতো ভালো কোনো হাসপাতাল নেই। আর এখানে চীনারা ভাইরাসটি মোকাবিলায় কঠোর পরিশ্রম করছে।
রাজনৈতিক চালের শিকার! নাদিমের মতো কয়েকজন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করলেও ভিন্ন চিন্তা করছেন অন্যরা। অনেকে সন্দেহ করছেন, চীন-পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈতিক চালের শিকার হয়েছেন তারা। পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হচ্ছে চীন। ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে এমনিতেই বিশ্বজুড়ে সমালোচিত চীন। প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটি নিয়ে তথ্য গোপনের চেষ্টা করেছিল চীনা কর্মকর্তারা। অনেক পাকিস্তানি দাবি করছেন, সব বিবেচনায় সেখান থেকে নিজেদের নাগরিক সরিয়ে নিয়ে চীনকে আরো লজ্জ্বায় ফেলতে চাইছে না পাকিস্তান। তাদের এ দাবি জোরদার হয় গত সপ্তাহে। চীনে করোনা ভাইরাস প্রকট হওয়ার পর দেশটিতে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে বহু দেশ ও আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স। কিন্তু পাকিস্তান সাময়িক বিরতি দিয়ে ফের তা চালু করেছে। চলতি সপ্তাহে ইমরান খানের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ড. জাফর মির্জা এক টুইটে, চীনে অবস্থিত পাকিস্তানিদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। সব দিক বিবেচনায় সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্তই নেয়া হবে। নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনারা আমাদের নিজেদের লোক, আমরা আপনাদের নিয়ে চিন্তিত।
পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে, ভাইরাসে আক্রান্ত হয়নি এমন ব্যক্তিরা দেশে ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু উহানের উপকন্ঠে অবস্থিত শিয়ানিং শহরে বাসকারী এক পাকিস্তানি শিক্ষার্থী দেশে ফেরার আবেদন জানালে প্রত্যাখ্যাত হন। মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের ক্ষোভান্বিত ওই শিক্ষার্থী এক টুইটে সরকারের উদ্দেশে লিখেছেন, ‘আপনারা আমাদের ব্যাপারে ন্যূনতম চিন্তাও করেন কি! আমাদের সবাইকে মেরে ফেলেন না কেন? আপনাদের জন্য এটা সহজ হবে। অথবা আমাদের চীনের কাছে বেচে দিন। এতে অন্তত কিছু সুবিধা পাবেন। আপনারা আমাদের মরার জন্য এখানে ফেলে রেখেছেন।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইব্রাহিম জানান, শিয়ানিংয়ে পরিস্থিতি প্রতিদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে নগদ অর্থ। খাবারের সংকট দেখা দিচ্ছে। ব্যাংক ও এটিএমগুলোও বন্ধ রয়েছে। প্রথম দিকে চীন সরকার ভাইরাস মোকাবিলায় সাধারণ জনগণের সাথে তাদেরও অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। ইব্রাহিম বলেন, ‘তিন দিন পানি ছাড়া ছিলাম আমরা। এরপর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রত্যেককে পাঁচ দিনের জন্য মাত্র চার লিটার করে পানি দিয়েছিল। পাকিস্তান সরকার আমাদের কোনো সাহায্য করছে না।’ এ ব্যাপারে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করলে তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতী জানায় পাকিস্তান সরকার।
এদিকে, এক ভিডিওতে চীন থেকে সরিয়ে নিতে পাকিস্তান সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পাঁচ পাকিস্তানি শিক্ষার্থী। ভিডিওতে তাদের বলতে শোনা যায়, ‘আমরা পাকিস্তান সরকারের কাছে অনুরোধ করছি, আমরা আপনাদেরই সন্তান। প্লিজ, প্লিজ প্লিজ, আমাদের সহায়তা করুন, এখান থেকে বের করে নিন।’