× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

করোনার প্রভাব চ্যালেঞ্জে মেগা প্রকল্প

প্রথম পাতা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার

চীনে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের বিরূপ প্রভাব দেশের উৎপাদন-বাণিজ্যে পড়া শুরু করেছে। পাশাপশি এ ভাইরাসের কারণে চ্যালেঞ্জে পড়েছে দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো। এগুলোর মধ্যে সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পও রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে সরকার। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, চীনা প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোয় ইতিমধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এগুলোর প্রত্যাশিত অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনা ভাইরাস। এভাবে চলতে থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই চলমান বড় প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি মারাত্মকভাবে পতন ঘটবে।

যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সমপ্রতি বলেছেন, প্রকল্পগুলোয় এখনো করোনা ভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। তবে পদ্মাসেতুতে কর্মরত চীনা নাগরিকরা আগামী দুই মাসের মধ্যে বাংলাদেশে না ফিরলে কিছু সমস্যা হবে।

এছাড়া সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল ও পায়রাবন্দরসহ বড় বড় অবকাঠামো খাতে কাজ করছেন শত শত চীনা নাগরিক।
তাদের ধারণা, করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে এসব প্রকল্পে বড় ধরনের প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানান, এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, করোনা ভাইরাসের কারণে চীনের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতির একটা বড় অংশ চীনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি দেশটির সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির সরকারের হিসাবেই করোনা ভাইরাসে ১৩০০ জনের অধিক মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। পরিস্থিতি এমন যে চীন হইতে আমদানি করিতে চাইলেও তা করা যাচ্ছে না। ফলে বর্তমানে চীন হইতে বাংলাদেশেও পণ্য আমদানি বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে চীনের সঙ্গে যোগাযোগও।

সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, কক্সবাজার-দোহাজারি রেলরুট, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ দেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ আরো অনেক প্রকল্পে চীনের ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও শ্রমিক যুক্ত আছেন। গত ২৫শে জানুয়ারি শুরু হয় চীনের নববর্ষ বা বসন্ত উৎসব। এ উৎসব উদযাপনকালে চীনের প্রায় ২০টি শহরের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এ উৎসবে যোগ দিতে বাংলাদেশে কর্মরত চীনা নাগরিকদের অনেকেই ছুটি নিয়ে নিজ দেশে যান। তাদের ছুটির মেয়াদ শেষ হলেও কাজে যোগ দিতে পারছেন না। কারণ সে ক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মধ্যেও করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাদের ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর যারা ছুটি কাটিয়ে ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন, তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পদ্মা সেতু। অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পে নির্মাণকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১১০০ কর্মী নিয়োজিত পদ্মা সেতুর কাজে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে চীনা নাগরিকদের ওপর নজরদারি বেড়েছে। অনেককে বিশ্রামে রাখা হয়েছে। ছুটিতে যাওয়া সে দেশের নাগরিকদের ছুটি আরো বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ছুটি আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য দেয়া হতে পারে বলে ধারণা করছেন প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের বলেন, পদ্মা প্রকল্পে কর্মরত ১১০০ চীনা নাগরিকের মধ্যে কমপক্ষে আড়াইশ ছুটিতে আছেন।

আরেক কর্মকর্মতা বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের নভেম্বরে। ইতিমধ্যেই ৩ দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ হিসাবে ২০২১ সালের জুনে কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে এগিয়ে চলছে এ প্রকল্পের কাজ। ছুটিতে থাকা শ্রমিক-প্রকৌশলীদের আরো পরে দেশে ফিরতে বলা হয়েছে। ফলে কাজের অগ্রগতিতে মারাত্মক ছন্দপতন লক্ষ্যণীয়।

এদিকে পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ এমনিতেই অনেক পিছিয়ে আছে। এই প্রকল্পে ৮৫৫ জন চীনা কর্মী যুক্ত। এর মধ্যে ৩৬৬ জন ছুটিতে গেছেন নববর্ষ উদযাপনে। ১৬ জন ফিরে এসেছেন, আরো ৯৭ জন ফিরতে পারেন। কিন্তু ২৫০ জনকে বাংলাদেশে আপাতত ফেরার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। বর্তমানে এ প্রকল্পের অগ্রগতি ২২ শতাংশ। পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নববর্ষে চীনে ছুটি কাটাতে যারা গিয়েছেন, তাদের আপাতত দেশে আনা হচ্ছে না।

এদিকে আগামী মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন করার কথা। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম জানান, চীনা স্টাফরা এ প্রকল্পে যুক্ত। তবে ভাইরাসের প্রভাবে অনেক কর্মীকে কাজ থেকে বিরত রাখা হয়েছে। ফলে উদ্বোধনপর্ব পিছিয়ে যেতে পারে।

পটুয়াখালী জেলার পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীন থেকে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরা ২০ চীনা নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মী।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার (রামু) রেললাইন প্রকল্পে অন্তত ৮০ চীনা নাগরিক সম্পৃক্ত। এর মধ্যে ৩১ জন ছুটিতে গেছেন চীনে। তাদের ৫ই ফেব্রুয়ারি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু তাদের বাংলাদেশে না আসার জর‌্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ এসব কর্মীর অনুপস্থিতিতে কাজে কিছুটা প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে সবার আগে দেশের স্বার্থ ও শারীরিক নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে।
আরেক প্রকল্প চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ। যেটি আগামী ৩ বছর পর চালু হওয়ার কথা। এই কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছিল। এ প্রকল্পটিও বাস্তবায়ন হচ্ছে চীনা অর্থায়নে দেশটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এই কাজও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বলে সেতু মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতাধীন ঢাকা বাইপাস রোড উন্নয়ন প্রকল্পেও চীনা কর্মী রয়েছেন। এ প্রকল্পে কর্মরত ৫০ চীনা নাগরিকের মধ্যে মাত্র দুজন বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছেন। তাদেরও ফিরে আসার কথা ছিল। তবে এ পরিস্থিতিতে তাদের ফিরতে বিলম্ব হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

রপ্তানি উন্নয়ন বুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে ১৩ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৮৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। দিন দিন উভয় দেশে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ছে। বর্তমানে চীন থেকে পণ্য জাহাজীকরণ, বুকিং এবং বিক্রি আপাতত বন্ধ। যেসব পণ্য দেশে আসছে সেগুলো এক মাস আগেই বুকিং করা। অন্যদিকে বাংলাদেশও চীনের নাগরিকদের অন অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ করেছে।
এফবিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীন সব সময় বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আমদানি-রপ্তানির একটা বড় অংশ দেশটির সঙ্গে জড়িত। শুধু তাই নয়, গত এক দশকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে চীনের। করোনা ভাইরাস চীনের অর্থনীতিতে সংকট তৈরি করলে বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

এদিকে গত ৬ই ফেব্রুয়ারি প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা সভাশেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পের যেসব চীনা কর্মী দেশে গেছেন, তাদের ছুটি দীর্ঘ হলে প্রকল্প কাজের অগ্রগতিতে সমস্যা হতে পারে। তবে আগামী দুই মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতিতে কোনো সমস্যা নেই। তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হয়েছে পদ্মা সেতুতে। তবে উড়াল সড়ক, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট ও মেট্রোরেল প্রকল্পে চীনা নাগরিকরা কর্মরত রয়েছে এবং করোনা ভাইরাস এসব প্রকল্পের অগ্রগতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

পদ্মা সেতুর অগ্রগতির বিষয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সব মিলিয়ে অগ্রগতি ৭৭ শতাংশ, মূল সেতুর ৮৬ শতাংশ এবং স্প্যান বসেছে ২৩টি।

প্রকল্পে চীনা নাগরিকদের পরিসংখ্যান দিয়ে মন্ত্রী বলেন, এখানে বর্তমানে ৯৮০ জন চীনা নাগরিক কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে ছুটিতে আছে ৩৩২ জন। ইতিমধ্যে ছুটি থেকে ফিরে এসেছে ৩৩ জন। ৩৩ জনের মধ্যে আটজন কোয়ারেন্টাইন মুক্ত, বাকিরা কোয়ারেন্টাইনে আছে।

উড়াল সেতুর অগ্রগতি নিয়ে কাদের বলেন, প্রথম ফেইজের অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। এখানে চীনা কর্মী রয়েছে ২০ জন, ছুটিতে ১৮ জন। এখানে কাজে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। মন্ত্রী জানান, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে ৭২ জন চীনার মধ্যে একজন ছুটিতে রয়েছে। এখানে সেতু বিভাগের অংশে অগ্রগতি ২০ শতাংশ।

মেট্রো রেল প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৪২ শতাংশ জানিয়ে সেতুমন্ত্রী বলেন, উত্তরা থেকে আগারগাঁও ৬৮ শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশে কাজ ৩৬ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত দশ বছরে একক দেশ হিসেবে চীন সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বাংলাদেশে। এই বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার।

সামগ্রিক বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনের করোনা ভাইরাসের স্বল্পকালীন প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। আবার যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল নির্ধারিত সময়ে পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। রোগটির প্রভাব বাড়লে পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে বলে জানান তিনি।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার ইন্টারন্যাশনাল ফায়ার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এক্সপো উদ্বোধনকালে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, করোনা ভাইরাসের কারণে আমরা একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। তারপরও আমরা সব দিকে লক্ষ্য রাখছি। করোনাভাইরাসের কী পরিমাণ চাপ আসতে পারে। সেটা নিয়ে একটা আলোচনা হচ্ছে।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর