দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে ২২টি বছর। দীর্ঘ সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। হারিয়ে যাওয়া সাথীরা মানবজমিন পত্রিকার উত্থানে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। প্রতি মুহূর্তে তাদের অনুপস্থিতি আমরা অনুভব করি। কিন্তু মরণশীল মানব সমাজ। এটাই সত্য।
আজিজ মিসির: যিনি পত্রিকার শুরুতেই সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ছিলেন মানবজমিন-এর প্রাণ।
২০০৩ সালের ৩রা অক্টোবর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রেখে যান তার কাছ থেকে পাওয়া অনেক উপদেশ, সাহস এবং এগিয়ে চলার মন্ত্র।
কবি সাযযাদ কাদির: যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন আমাদের সঙ্গে। তার ভাষা জানা সম্পর্কে কিছু বলার স্পর্ধা আমার নেই। বাংলা ডিকশনারি বলতাম তাকে। যেখানে আটকে যেতাম, সেখানেই তিনি। জট খুলে দিতেন বানানের, রাজনীতির কিংবা চলচ্চিত্রের খুঁটিনাটি বিষয়ের। তিনি কবি এবং বাংলার শুদ্ধ শব্দ গঠনের পণ্ডিত ছিলেন। তিনিও হারিয়ে গেলেন আমাদের মাঝ থেকে। তার চলে যাওয়া আমাদের যেমন বিরাট ক্ষতি, তেমনি ক্ষতি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের বাংলাদেশের।
কাজী আদর: মানবজমিন পত্রিকার বিশেষ প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার লেখা আমার কাছে প্রিয় লেখা মনে হয়েছিল প্রতিদিনই। তিনি অনেকটা নিজেকে আড়ালে রেখেই চলে গেছেন। প্রতিদিন সকাল বেলায় তার ভাই ডাকটা আর শুনি না। চকলেট, শসা, মুড়ি কিংবা চানাচুর দিয়ে মিষ্টি হাসিটাও তিনি আর দিতে আসেন না। দীর্ঘদিনের এই প্রিয় মানুষকে হারিয়ে আমরা শোকাহত। তবে তার লেখা আমাদের প্রতিটি মুহূর্তকে জীবিত করে রাখে।
আহমেদ ফারুক হাসান: মানবজমিন পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাই ছিল অন্তরের। আমি লিখতে জানতাম না। তিনি প্রায়শই আমার লেখা ঠিক করে বলতেন, ‘এই কুদ্দুছ্যা-লেখাটা দেখিয়েন।’ তিনি রাগ করতেন। কিন্তু সে রাগ ছিল সৃষ্টির। একটা মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশক হিসেবে। সকাল ৯টা থেকে রাতে পত্রিকা নিয়ে ঘরে ফিরতেন। এমন একজন কাজপাগল মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর।
আওলাদ হোসেন: বিনোদন বিভাগের সিনিয়র সাংবাদিক। তিনি ছিলেন আমাদের প্রাণশক্তি। একটা পিকনিক শেষ হলে আর একটির মহড়া দিতেন। অফিসে ঢুকেই বলতেন আমি এলাম। চলেন, চা খেয়ে আসি। এমন একজন প্রাণবন্ত মানুষকে আমরা হঠাৎ-ই হারিয়েছি। তার হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট আমরা ভুলিনি-ভুলতে পারবো না।
আবু বক্কর সিদ্দিক: বয়সে ছোট। অপূর্ব সুন্দর একটা যুবক। দেখলেই সালাম দিতেন। কথা বলতেন আস্তে। এমন নম্র-ভদ্র একজনকে পাওয়া খুবই কষ্টের। মানবজমিন পরিবারের সবার প্রিয় ছিল বক্কর। আকস্মিক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সে চলে গেল। মানবজমিন পরিবার আছে। তার বসার চেয়ার টেবিল-কম্পিউটার আছে-শুধু সে নেই।
মো. আমির হোসেন: হবিগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। আইন পেশায় জড়িত আমির হোসেন মনে-প্রাণে ছিলেন একজন সাংবাদিক। একজন ভালো মানুষ। সিনিয়র একজন হয়েও তিনি সালাম দিতে ভুল করেননি কখনো। তার চলে যাওয়া আমাদের কাঁদিয়েছে। তার কর্মকাণ্ড কোনদিনই আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাবেন না।
মো. আবু জাফর খান: পটুয়াখালী প্রতিনিধি, সারা জীবন আমাদের সঙ্গে ছিলেন আবু জাফর। যেমন ছিলেন মিশুক তেমনি বন্ধুবৎসল ছিলেন। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
মো. আবুল কাসেম: কম্পিউটার বিভাগে কাজ করতেন। কখনো দেখিনি তিনি রাগ করেছেন। কোনো লেখা কম্পোজের জন্য অনুরোধ করতে হয়নি। হঠাৎ একদিন শুনি সদা হাস্যোজ্জ্বল মানুষটি ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুর আগের দিনও মুখের হাসিটা ম্লান হতে দেখিনি। ভালো মানুষকে সৃষ্টিকর্তা হয়তো বেশিদিন পৃথিবীতে রাখেন না। কাসেম তারই একজন।
মনোয়ার হোসেন: ক্রীড়া বিভাগে কাজ করতেন। যার মুখে সবসময়ই হাসি ছিল। কে কেমন আছি প্রথমেই জানতে চাইতেন। ডেক্সে বসে নীরবে কাজ করতেন। একদিন অফিসে এসেই জানতে পারলাম হার্টঅ্যাটাকে তিনি মারা গেছেন। খেলাপাগল এ মানুষটি আর নেই ভাবতেই পারছিলাম না। কারণ খুব কাছাকাছি বসতাম আমরা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা হতো। তবে প্রতিটি কথাই বলতেন বিনয়ের সঙ্গে। কর্মচঞ্চল মনোয়ার হোসেন আমাদের স্মৃতিতে আছেন, থাকবেন।
ফিরোজ আহমেদ স্বপন: নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি। ঢাকায় আসতে ভয় পেতেন। জীবনে মাত্র একবার এসেছিলেন মানবজমিন পত্রিকা অফিসে। তা-ও দুজনকে সঙ্গে নিয়ে। মানবজমিন পরিবারের কেউই তাকে দেখেননি। শামীম ভাই, আবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হতো ফোনে। ভদ্র-নম্র, বিনয়ী এ মানুষটি ছিলেন আমাদেরই একজন। খুব অল্প বয়সে মুহূর্তের একটি ধাক্কা। হার্টঅ্যাটাকে তিনি চলে যান না ফেরার দেশে।
শাহনেওয়াজ জাহান: সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ছিলেন। তার চেহারা দেখে মনে হতো তিনি খুব রাগী। মুখোমুখি দাঁড়ালে মনে হতো একটা শিশু। রাগ করতে জানতেন না। এসে বলতেন, একটা ছবির বিশেষ দৃশ্যে অভিনয় করতে এসেছি। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান-এটা তিনি উচ্চারণ করতেন গর্বের সঙ্গে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি অকালে চলে গেলেন। তিনি আমাদের কাছে ভালো একজন হয়ে আছেন, থাকবেন।
এসএম ওহাব আলী: ওহাব আলী ছিলেন গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি। তার সঙ্গে আমার কোনদিন দেখা হয়নি। কথা হয়েছে। একজন নিভৃতচারী মানুষ। নিউজ পাঠিয়ে খোঁজ নেননি। তদবির করেননি। কিন্তু নিউজ প্রকাশিত হলে ফোন করে বলতেন, ভাইয়া নিউজ পেয়েছি। পত্রিকা ভালো চলছে। ক্যান্সার তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের মন থেকে তাকে সরাতে পারেনি। তিনি আছেন একজন নীরব প্রতিনিধি হয়ে।
সেলিম রেজা: পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। ঢাকায় ২-১ মাস পর পরই আসতেন। একজন ভদ্র ছেলের মতো বসে থাকতেন শামীম ভাইয়ের পাশে। জোরে কথা বলতেন না। এক কাপ চা পানের বায়না করতেন। না খাইয়ে কখনো যেতে চাইতেন না। কিন্তু ক্যান্সার তাকেও কেড়ে নিলো। সদ্য বিবাহিত বউ রেখে বিদায় নিলেন। তার চলে যাওয়ার আকস্মিক খবর আমাদেরকে করেছে।
মো. আবুল কাসেম: নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। হঠাৎ বিকাল ৫টার দিকে ফোন, ভাই নিউজ পাঠিয়ে দিলাম। আমি মতিঝিল থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে যাচ্ছি। ১৫ মিনিট পর আবার ফোন ফতুল্লার সানারপাড় থেকে দৈনিক জনকণ্ঠের স্টোরকিপার বলছি, তিনি বলেন, টেম্পো দুর্ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। তার পকেটে একটি আইডি কার্ড পাওয়া গেছে। এতে লেখা মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক। খোঁজ নিয়ে জানা গেল আমাদের আবুল কাসেমই সেই নিহত ব্যক্তি। তার এই মৃত্যুতে আমরা খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। এমন ভালো মানুষ হয়তো আর পাওয়া যাবে না।
বাবর মাহমুদ: লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি ছিলেন। খুব অল্প সময় আমাদের সঙ্গে থেকে তিনি নিজেকে যোগ্য করে তুলেছিলেন। ছিলেন একজন সৎ মানুষ এবং আদর্শবান পুরুষ। লক্ষ্মীপুর থেকে ঢাকায় আসার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। এরপর তাকে রাখা হয়েছিল স্কয়ার হাসপাতালে। দেখতে গিয়েছিলাম। চিকিৎসক আমাকে তার বেডের কাছে নিয়ে বলেছেন, মানবজমিন থেকে কুদ্দুস ভাই আপনাকে দেখতে এসেছেন। ওই সময় তিনি চোখ মেলেননি। হাত নাড়াতে পারেননি। তবে তার দুই চোখের জলধারায় বালিশ ছুঁয়েছে। পক্ষকাল মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে সবাইকে ছেড়ে তিনি চিরবিদায় নেন।
সামাদুল ইসলাম: মেহেরপুর প্রতিনিধি। মৃত্যুর মাস খানেক আগে আইডি কার্ডের ছবি দিয়ে যান। এরপর তার আর কোনো সন্ধান পাইনি। হঠাৎ একদিন জানতে পারি সামাদুল ইসলাম আর নেই। মনে পড়েছে, মোংলা প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদ, পাকুন্দিয়ার মানিক আহমেদ, মাদারীপুর জেলার কালকিনি প্রতিনিধি দেলোয়ার হোসেন, নীলফামারী জেলার জলঢাকা প্রতিনিধি শামসুল আলম, রংপুর বদরগঞ্জের রমজান আলী, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী প্রতিনিধি রেজাউল ইসলাম বাবুল যাদের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত কথা হতো। ভালো-মন্দ সব কথাই বলতেন আমাকে। আজ তারাও আমাদের ছেড়ে দূরপরবাসে। কোনোদিন তাদের সঙ্গে আর দেখা হবে না। কথাও হবে না। পরিশেষে, এখনো আমরা আছি। আগের মতোই কাজ করছি। কথা বলছি। আজ তাদেরকে স্মরণ করতে গিয়ে সবকিছু্ই গুলিয়ে ফেলছি। ওরা এখন পরপারের বাসিন্দা। এতটুকুই বলবো, ভালো থাকবেন পরপারে।