চুড়িহাট্টা। যেখানে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছে ৭১ জন মানুষ। কেমিক্যালের গোডাউন, পারফিউম, বডিস্প্রে বিস্ফোরিত হয়েছিলো এক একটি বোমার মতো। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, শিল্প মন্ত্রনালয়, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বিস্ফোরক পরিদপ্তর, ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) পৃথকভাবে তদন্ত করেছে। তদন্ত প্রতিবেদনও জমা হয়েছে। আগুনের সূত্রপাত, প্রতিকার নিয়ে সুপারিশও করা হয়েছে। কিন্তু বদলায়নি কিছুই। যেই চুড়িহাট্টা এখনও সেই চুড়িহাট্টাই।
নেই তেমন কোনো পরিবর্তন। বেশ কয়েক অভিযান হয়েছিলো। তবুও তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এজন্য সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্তে নামেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। ২৪শে মার্চ মহাপরিচালকের কাছে জমা দেয়া হয় তদন্ত প্রতিবেদন। আবার যেনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে এজন্য এতে ২৫টি সুপারিশ করা হয়। একইভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কর্তৃক তদন্ত প্রতিবেদনে ৩১টি সুপারিশ করা হয়।
দীর্ঘ তদন্তের পর প্রতিবেদন জমা দিলে নানা প্রতিকূলতায় সুপারিশগুলো ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। বাস্তবে বেশ কয়েক অভিযান হলেও সুফল আসেনি। এখনও আগের মতোই সরু রাস্তা, গিঞ্জি এলাকার নাম চুড়িহাট্টা, পুরান ঢাকা। আগের মতো খোলামেলা না হলেও পুরান ঢাকার এসব এলাকায় রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন সংশ্লিষ্টদের কোনো অনুমোদন দিচ্ছে না। তবে তাদের করা সুপারিশ কখন আলোর মুখ দেখবে এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারেননি তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান এতে সংশ্লিষ্ট থাকায় একা কোনো প্রতিষ্ঠান সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এখানে স্বরাষ্ট্র, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, গণপূর্ত, শিল্প মন্ত্রনালয়, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জড়িত। সবার সমন্বয়ে সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিককে দায়ী করা হয়েছে। ওই ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় গুদামজাত করা ছিলো বিপুল পরিমাণ বডি স্প্রে, এয়ার ফ্রেশনার, অ্যারোসল, গ্যাস লাইটার ইত্যাদি। দাহ্য রাসায়নিক থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের আগে ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলায় গ্যাস রিফিলিংয়ের কাজ চলছিল। সেখান থেকে বিস্ফোরণ ঘটে এবং এই আগুন পুরো এলাকায় ছড়িয়ে যায়। একইভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাসায়নিকের গুদাম থেকেই আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন ছাড়াই নন্দকুমার রোডের ওয়াহেদ ম্যানশনসহ ক্ষতিগ্রস্ত চারটি ভবন তৈরি করা হয়েছিলো। রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসা খুলেছিলো এসব ভবনে। অবশ্য অনুমোদন ছিলো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। শুধু ওই ম্যানশনেই ১৬টি ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করেছিলো সিটি করপোরেশন। যদিও সিটি করপোরেশন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছে, এই লাইসেন্সগুলো শুধু দোকান পরিচালনার জন্য দেয়া হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখযোগ্য সুপারিশ হচ্ছে, অবৈধ, অনুমদোনহীন বা লাইসেন্সবিহীন রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমন্বিত অভিযান পরিচালনা, আবাসিক এলাকায় সব ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য রাসায়নিক ব্যবসার লাইসেন্স না দেয়া এবং অবিলম্বে পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকায় সব ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক, পলিথিন, জুতা, নকল ওষুধ, নকল প্রসাধন তৈরির কারখানা, দাহ্য রাসায়নিক কারখানা ও গোডাউনের তালিকা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আবাসিক এলাকায় যে কোনো ধরনের রাসায়নিকের দোকান বা গুদাম রাখা যাবে না। ওই এলাকার রাস্তা ও গলিপথগুলো সরু হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটলে বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তা নির্বাপন করা দুষ্কর। তাই রাস্তা ও গলিগুলো কমপক্ষে ২০ ফুট প্রশস্ত করতে হবে। এসব রাস্তায় স্ট্রিট হাইড্রেন্ট স্থাপন করে নির্দিষ্ট দূরত্বে পানির প্রবাহ নিশ্চিত রাখতে হবে।
এমনকি স্থায়ী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করে ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ নিতেও সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। পুরান ঢাকার অবৈধ বিদ্যুৎ, গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি পুরনো লাইন পরিবর্তন করে ঝুঁকিপূর্ণ এলোমেলো ঝুলন্ত বৈদ্যুতিক, টেলিফোন ও ডিশ লাইনের তার সুবিন্যন্ত অথবা ভূ-গর্ভস্থ সঞ্চালনের সুপারিশ করা হয়েছে। ভবন ও মসজিদের সামনে পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতেও প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়।
বিশেষ করে হাসাপতাল, কমিউনিটি সেন্টার, ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় ও স্কুল-কলেজে কমপক্ষে দেড় লাখ গ্যালন পানি ভূ গর্ভস্থ রিজার্ভার করার পরামর্শ দেয়া হয়। বহুতল প্রতিটি ভবনের সামনে রাস্তা প্রশস্ততা নূন্যতম ৯ মিটার হতে হবে। এছাড়াও ভবনের চারপাশে কমপক্ষে ৪ দশমিক ৫ মিটার প্রশস্ত জায়গা থাকতে হবে। এসব বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক দীনমনি শর্মা জানান, সুপারিশ বাস্তবায়ন করা কর্তৃপক্ষের ব্যাপার। আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আশা সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অগ্নিকাণ্ড অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করেন তিনি।