বিশ্বনাথের সুমি। ওসমানীনগরের লিপি। দুজনই সিলেটের ইয়াবা ব্যবসায়ী তবারক ওরফে সুমনের ইয়াবা নেটওয়ার্কের সক্রিয় কর্মী। ইয়াবা বহনই তাদের পেশা। স্বামীর পরিচয়ের সূত্র ধরে তবারকের ইয়াবা নেটওয়ার্কে জড়ায় তারা। আর সেই তবারকের নির্দেশে তারা ৪০ হাজার পিস ইয়াবা টেকনাফ থেকে সিলেট নিয়ে আসছিলেন। পথিমধ্যে কুমিল্লায় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে। আর গ্রেপ্তারের পর সুমি ও লিপি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে বিশ্বনাথের তবারকের নাম।
এই ইয়াবার চালান তবারকের নির্দেশেই তারা সিলেট নিয়ে আসছিল বলে জানায়। সোমবার রাতে তাদের কুমিল্লা গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। কুমিল্লা ডিবি পুলিশ জানায়- সোমবার রাতে টেকনাফ থেকে ৪০ হাজার পিস ইয়াবাসহ একটি লাগেজ বহন করে নিয়ে আসছিলেন সুমি ও লিপি। কুমিল্লায় এসে তারা গাড়ি পরিবর্তনের সময় ডিবি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সুমি ও লিপি তারা দুজন বর্তমানে কুমিল্লা কারাগারে রয়েছে। তাদের দুইজনের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা দায়ের করেছেন কুমিল্লা ডিবির সাব ইন্সপেক্টর পরিমল চন্দ্র দাস। তিনি গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- সুমি ও লিপিকে গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা সিলেটের ইয়াবা বিক্রেতা তবারক ওরফে সুমনের নাম বলেছে। এই ইয়াবার চালান তবারকের বলেও জানিয়েছে। তারা কেবল বহন করেছে বলে জানায়। তিনি জানান- যেহেতু এখনো পুরোপুরি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি এ কারণে তাদের রিমান্ডে আনা হবে। এদিকে- চালান গ্রেপ্তারের পর পরই পুলিশ তবারককে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। সিলেটের বিশ্বনাথ থানার ওসি শামীম মুছা জানিয়েছেন- ইয়াবার চালান যেহেতু তবারকের সে কারণে তাকে খোঁজা হয়। কিন্তু ইয়াবার চালান আটকের পর থেকে সে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তাকে পুলিশ খুঁজছে বলে জানান তিনি। সুমি বেগমের বাড়ি বিশ্বনাথের জানাইয়া গ্রামে। তার স্বামী দুলন মিয়া। আর লিপি বেগমের বাড়ি ওসামানীনগর উপজেলার পুরান সৎপুর গ্রামে। স্বামীর নাম সুরুজ মিয়া। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- বিশ্বনাথের আল হেরা মার্কেটে তবারক ওরফে সুমনের একটি কাপড়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন দুলন। ব্যবসাসহ পারিবারিক পরিচয়ের সূত্র ধরে তবারকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল দুলন ও সুরুজের। তবারক তার স্ত্রী সাবিনা আক্তারকে দিয়ে মহিলা ইয়াবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। গত ৫ই ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জ পুলিশের হাতে ৬১ হাজার পিস ইয়াবার একটি বড় চালানসহ গ্রেপ্তার হয়েছে সাবিনাসহ তিন নারী। তারা বর্তমানে হবিগঞ্জ কারাগারে রয়েছে। এই তিনজন আটক হলেও তবারক পলাতক রয়েছে। পুলিশ জানায়- তবারক বাইরে থাকায় তার ইয়াবা ব্যবসা এখনো চলছে। স্ত্রীসহ তিন মহিলা গ্রেপ্তার হওয়ার পর সুমি ও লিপিকে ইয়াবা বহনে নামায় তবারক। সর্বশেষ তাদের দুইজনকে দিয়ে টেকনাফ থেকে ইয়াবার চালান নিয়ে আসছিল। আর পথিমধ্যে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ায় ফের তবারকের ইয়াবা ব্যবসার নেটওয়ার্কের খবর পুলিশের কাছে এসেছে। আর সুমি ও লিপি গ্রেপ্তারের পর তাদের স্বামী দুলন ও সুরুজ মিয়াও লাপাত্তা। তাদেরও খোঁজ করছে পুলিশ।
কে এই তবারক: বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের পাঠাকইন গ্রামের মৃত আলকাছ আলীর পুত্র তবারক আলী। মাদকের জগতে সে ইয়াবা সুমন নামে পরিচিত। আর তার নিয়ন্ত্রণে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গঠিত মাদকের সিন্ডিকেট রয়েছে। গাড়ির চালক হওয়ার পরই অপরাধ জগতে পা রাখে তবারক। শুরু করে গাড়ি চুরি। ‘পলিথিন তবারক, চানাচুর তবারক, পিচ্চি তবারক’সহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নতুন নাম পায় তবারক। গাড়ি চুরি করা শুরুর কিছু দিনের মধ্যেই তবারক আন্তঃবিভাগীয় গাড়ি চোর দলের একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠে। ২০১০ সালের ১লা এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট বিভাগের বিভিন্ন থানায় তবারকের বিরুদ্ধে চুরি-ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৭টি মামলা ও ২টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়েরের তথ্য পাওয়া গেছে। একাধিক চুরির মামলার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ২০১১ সালের ২৪শে নভেম্বর বিশ্বনাথ থানা পুলিশ তবারককে ২ দিনের রিমান্ডে আনে। আর পরদিন বিকাল ৩টার দিকে হাতকড়াসহ থানা হাজত থেকে পালিয়ে যায় সে। অবশ্য পালিয়ে যাওয়ার ৭ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে আবার গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২০১৬ সালে জেলহাজতে একজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তবারকের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসে ইয়াবা বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে তবারক আলী। ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে বিশ্বনাথ থানায় আরো দুটি মামলা ও দুটি জিডি দায়ের করা হয়। এ বছরের ২৬শে আগস্ট ৩৬(১) এর ১৯(ক) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ অনুযায়ী বিশ্বনাথ থানার এসআই দেবাশীষ শর্মা বাদী হয়ে তবারকসহ ৩ জনকে অভিযুক্ত করে একটি মামলা করেন। এ ঘটনায় বিশ্বনাথ-লামাকাজী সড়কের আমজদ উল্লাহ কলেজের সামনে থেকে আধা কেজি গাঁজাসহ বহুল আলোচিত তবারকের স্ত্রী সাবিনা বেগমের মালিকানাধীন সিএনজিচালিত অটোরিকশা (সুনামগঞ্জ-থ ১১-২০৬৭) জব্দ করে পুলিশ। আর গত ২৪শে অক্টোবর আদালতে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে অভিযুক্ত করে থানা পুলিশ সেই মামলার চার্জশিট আদালতে প্রেরণ করে। এরপর একই বছরের ১৬ই অক্টোবর সরকারের বিভিন্ন দপ্তর বরাবরে তদন্ত সাপেক্ষে তবারক আলী ওরফে ইয়াবা সুমনকে আইনের আওতায় আনার দাবিতে রামপাশা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ এলাকায় প্রায় ৩ শতাধিক ব্যক্তি স্বাক্ষরিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়।