সকাল তখন সাড়ে ১০টা। সিলেট নগরীর আম্বরখানা পয়েন্ট। তেমন ভিড় নেই। এরপরও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন কিছু মানুষ। কেউ সিএনজি অটোরিকশা, আবার কেউ রিকশাচালক। নিত্যপ্রয়োজনীয় দোকানের সামনে ছিলেন কেউ কেউ। এমন সময় সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ি গিয়ে থামে আম্বরখানা পয়েন্টে। মুহূর্র্তে বদলে গেল পরিবেশ।
চালকরা গাড়ি নিয়ে উধাও। যারা অপ্রয়োজনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তারাও চলে গেছেন। পিনপতন নীরবতা নেমে এলো আম্বরখানায়। স্থানীয় এক মুদি দোকানি জানালেন- ‘কেউ কারো কথা মানছে না। বার বার আমরা অনুুরোধ করছি চলে যান। কিন্তু কেউ কথায় কান দেয়নি। এখন সেনাবাহিনীর সদস্যরা আসায় স্বস্তি পেলাম।’ এরপর সেনা সদস্যরা বিমানবন্দর সড়ক দিয়ে চলে যান। পথিমধ্যে কিছু মানুষের জটলা দেখলেই তারা থামেন। তাদের দেখে ভিড় কমে যায়। একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গতকাল সেনাদের ওই টিম নগরের বিমানবন্দর এলাকায় টহলে ছিলেন। সিলেটের ধোপাগুল। বাণিজ্যিক স্থান এটি। স্টোন ক্রাশার মিলের এলাকা। এই সময়েও স্টোন ক্রাশার মিল সচল। শ্রমিকরা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছিলেন। এলাকার মানুষ ক্রাশার মিল বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। মালিকরা মানেনি সে অনুরোধ। দিব্যি তারা সচল রেখেছিলেন মিল। দুপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে সেনা সদস্যরা সেখানে যান। তারা গিয়ে বন্ধ করে দেন স্টোন ক্রাশার মিল। স্বস্তি ফিরে এলাকায়। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- স্টোন ক্রাশার মিলের ধুলোর কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ ছিলেন। অবশেষে বন্ধ হয়েছে। এজন্য তারা সেনা সদস্যদের ধন্যবাদ জানান। সিলেট হচ্ছে প্রবাসী শহর। এখনো আসছেন প্রবাসীরা। এ কারণে করোনা ভাইরাস ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেট। এই ঝুঁকি মোকাবিলায় সিলেটের মানুষও সচেতন। প্রায় ৪ দিন আগে থেকেই সিলেট সতর্ক। রাস্তায় মানুষের যাতায়াত ছিল সীমিত। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই চলছিলেন তারা। আর গতকাল থেকে সেই দৃশ্যপটও বদলে গেছে। সিলেট পরিণত হয়েছে অচেনা নগরীতে। গোটা নগরই নীরব, নিস্তব্ধ। মাঝে মধ্যে জরুরি প্রয়োজনে দু’একটি রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল করছে। বেলা তখন ২টা। নগরীর কোর্ট পয়েন্ট। সিলেট নগরীর সবচেয়ে ব্যতিব্যস্ত এলাকা। কিন্তু বেলা দুইটায় ফাঁকা কোর্ট পয়েন্ট। জনমানব শূন্য। কোর্ট পয়েন্টে নেই গাড়ির জটলা। কেউ নিয়ে আসছেও না। হকারের দৌরাত্ম্য নেই। দোকানপাট বন্ধ। নীরব দাঁড়িয়ে আছে ওভারব্রিজ। তেমনি অবস্থা সিটি পয়েন্ট ও সুরমা পয়েন্টেও। সুরমা পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একদল পুলিশ। হাতে হ্যান্ডমাইক। বার বার ঘোষণা- ‘চলে যান। দূরে দূরে অবস্থান করুন, কিংবা হাঁটুন।’ একজন পুলিশ সদস্য ক্রমাগত বলেই চলেছেন। ঘরে ফেরারও তাগিদ দিচ্ছেন। ২৪ ঘণ্টায়ই ব্যস্ত থাকে সিলেটের কীন ব্রিজ। উত্তর-দক্ষিণের সংযোগ ব্রিজ। সেই ব্রিজও হয়ে পড়েছে নীরব। ব্রিজের দু’পাশে থাকেই পত্রিকা বিক্রেতা হকারদের দৌড়াদৌড়ি। সিলেটে কোনো হকার নেই। সব স্থানীয় পত্রিকা বন্ধ। জাতীয় পত্রিকাও আসেনি ঢাকা থেকে। ফলে অলস সময়ের সংবাদপত্র হাতে পাচ্ছেন না সিলেটের মানুষ। সিলেটের প্রবেশ মুখ দক্ষিণ সুরমা। এতো নীরব হয়নি আগে কখনো। ঈদের সময়ও ওই এলাকায় থাকে মানুষের কোলাহল। ট্রেন স্টেশন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। গেটলক। বাস টার্মিনালও ফাঁকা। দূরপাল্লার যানবাহনগুলো জনমানবহীন টার্মিনালে পড়ে আছে। মাঝে মধ্যে পুলিশের গাড়ি সড়ক দিয়ে যাচ্ছে। দু’একটি এম্বুলেন্সও আছে। আর কিছুই নেই। সব বন্ধ। দক্ষিণ সুরমা যেন ঘুমন্ত জনপদ। গাড়ি ধোয়ায় ব্যস্ত ছিলেন পরিবহন শ্রমিক। মুখে মাস্ক ও হাতে গ্লাভস পরে গাড়ি পরিষ্কার করছেন। জানালেন- গাড়ি ধোয়া শেষ হলেই চলে যাবেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আর ফিরবেন না। সিলেটের জিন্দাবাজার। মার্কেটের এলাকা। সব মার্কেট বন্ধ। পাঁচ ভাই, পানসি, পালকি রেস্টুরেন্টের নাম সবাই জানেন। এই রেস্তরাঁগুলোতে সব সময়ই মানুষের গিজ গিজ থাকে। কিন্তু সব রেস্টুরেন্ট বন্ধ। চৌহাট্টা ও রিকাবী বাজারের অবস্থাও একই। তবে নিত্যপ্রয়োজনী দ্রব্যসামগ্রীর দোকানগুলো খোলা রয়েছে। ফাঁকা, অস্বস্তির নগরে বিকালে আইইডিসিআর থেকে এসেছে স্বস্তির খবর। সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আইসোলেশনে থাকা তিন রোগীর রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে। সবার রিপোর্ট নেগেটিভ। অর্থাৎ কেউ করোনা আক্রান্ত নয়। বিভাগীয় অতিরিক্ত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানালেন- ওসমানী বিমানবন্দরের এক আনসার, একজন ডাক্তার এবং একজন লন্ডন প্রবাসীর রক্তের নমুনা ঢাকায় পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল। তাদের সবার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এটা সিলেটের জন্য স্বস্তির খবর। প্রবাসী শহর হলেও এখনো সিলেটে কোনো করোনা ভাইরাস রোগী মেলেনি। ক্রমেই কমছে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। আনিস জানান- নতুন করে ১৩৭ জনকে নেয়া হয়েছে হোম কোয়ারেন্টিনে। তবে- কোয়ারেন্টিন থেকে মুক্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ৫০০’র মতো। সরকারি হিসেব মতে এখন সিলেটে হোম কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৫৯৭ জন।