সামান্য কটা মুড়ি খেয়ে বিছানায় যান শাহজাহান মিয়া। নির্ঘুম সারারাত। ভোর না হতেই ক্ষুধায় পেট মোচড় দিয়ে ওঠে। কিন্তু ঘরেতো কোন ভাত নেই। পানি পান করলেও ক্ষুধা নিবারণ হলো না। ওদিকে বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মাও একরকম না খাওয়া। তবুও কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছে না। ক্ষুধায় কাতর ছোট্ট মেয়ে দুটাও।
হাতেও কোন কাজ নেই। মাথায় রাজ্যের চিন্তা। ঘরে যে একমুঠো চালও নেই। সামান্য যে আয়ে পরিবারটা চলত তাও বন্ধ করোনার এপরিস্থিতে।
এতো গেলো শাহজাহান মিয়ার গল্প। ভাবুন, আপনি ঘরের চালে বসা। চারিদিকে পানি আর পানি। আদরের শিশুটি কোলে। কোল ছাড়া হলেই মৃত্যু নিশ্চিত। সাপের কামড়ের ভয় তো আছেই। হঠাৎ লক্ষ করলেন আপনার শরীরে দেখা দিয়েছে চর্ম রোগ। দিন রাত ভেজা কাপড়ে খাবারের সন্ধান করেও বাচ্চার বাবা জোটাতে পারছে না একটু খাবার।
আরও একটু ভাবুন, তীব্র শীত। শুধু ছেড়া একটা জামা গায়ে দিয়ে হচ্ছে আপনার শীত নিবারণ। বাড়িতে খাবার নেই, বেরিয়েও যে কাজ পাবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নাই। সামান্য কটা টাকার অভাবে করাতে পারছেন না চিকিৎসা। সন্তান চাইলেও কই আর যেতে পারছে স্কুলে।
ঠিক এমন অবস্থাতেই দিন কাটে উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের। তীব্র শীত, বন্যা, নদী ভাঙ্গন ও অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করা তাদের নিত্যদিনের কাজ। এসব অসহায় মানুষগুলোর পাশে সহোযোগিতা নিয়ে বরাবরই পাশে দাঁড়ান রংপুরের স্বপ্নবাজ কিছু তরুণ। কলেজ পড়ুয়া কজন মিলে গড়ে তোলেন একটি দাতব্য সংগঠন। নাম ‘হিউম্যান ইফোর্টস ফর লোকাল পিপল’ (হেল্প)। তাদের লক্ষ্য হলো রংপুর বিভাগজুড়ে দারিদ্র্য আর দূর্যোগ পিড়ীতদের পাশে দাঁড়ানো। মানবতার এই ফেরিওয়ালাদের সংগঠন 'হেল্প'র পেরিয়েছে ১০টি বছর।
যেভাবে যাত্রা শুরু২০১০ সাল। 'হেল্প'র প্রতিষ্ঠানকালীন সদস্য রকিবুল ইসলাম বন্ধুদের জানান রংপুরের গজঘণ্ট নামক স্থানে চরের মানুষরা শীতে ভিষণ কষ্টে আছেন। কালেক্টরেট স্কুল এণ্ড কলেজ, রংপুর থেকে ২০০৯ সালে মাধ্যমিক পাস করা এই শিক্ষার্থীরা তাদের সাহাযার্থে পুরাতন কাপড় সংগ্রহ শুরু করেন। তাদের ধারণার থেকেও অধিক পরিমাণ সংগ্রহ হয়ে যায়। সেবার সেখানে প্রায় ৫শ' মানুষকে শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়। সেখান থেকেই শুরু। ২২শে ডিসেম্বর থেকে যাত্রা শুরু করে দাতব্য সংগঠন 'হেল্প'।
'হেল্প'র কার্যক্রমযাত্রা শুরুর পরে চলার পথটা মোটেও সহজ ছিলো না। পেরোতে হয়েছে চড়াই-উতরাই৷ থেমে থাকেনি 'হেল্প'। প্রতিবছর শীতে পথশিশুদের শীতবস্ত্র - প্রত্যন্ত গ্রামে কম্বল বিতরণ, ফ্রি স্বাস্থ্য সেবা, ঈদে পথশিশুদের পোশাক ও এতিমদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ বিলিয়েছেন তারা। এছাড়াও কর্মসংস্থানের জন্য রিকশা বিতরণ, নিয়মিত বৃক্ষরোপণ, শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে 'হেল্প'। পাশাপাশি অসহায় ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়বহন, দরিদ্র কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার পাশে অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে 'হেল্প'। হেল্প'র রয়েছে 'হেল্প ব্লাড ডোনার কমিউনিটি'। যার মাধ্যমে সদস্যরা নিয়মিত রক্ত দান ও রক্তের ব্যবস্থা করে থাকেন।
২০১৭ সালে উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা আঘাত হানে। অনেকেই বলেন, ১৯৮৮'র থেকেও অধিক ক্ষতি হয়েছে সেই বন্যায়। সেবার বন্যায় ৪টি অংশে ভাগ করে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। দিনাজপুরে ২৫০টি পরিবার, রংপুরের গজঘণ্টায় ১০০টি , কুড়িগ্রামের তিস্তা ব্যারেজে ৪০০টি এবং কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে ২০০টি পরিবারে কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্ধকৃত প্যাকেটে ছিল ৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি ডাল, ১/২ কেজি লবণ , ৫টি দিয়াশলাই, ১টি সাবান, ৪ প্যাকেট স্যালাইন ও ১০০ টাকা। এছাড়াও প্রতিটি ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে ছিল হেলথ ক্যাম্প।
বন্যা-পরবর্তীতে শীত জেঁকে বসে উত্তরবঙ্গে। আবারও বেরিয়ে পরে 'হেল্প'। ৫৫০ টি জ্যাকেট বিতরণসহ ৩ হাজার শীতবস্ত্র বিতরণ করেন তারা। 'হেল্প'র সহযোগিতার হাত নির্দিষ্ট কিছু কর্মকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। একটি এতিমখানায় প্রায় ১শ' এতিমের মাঝে ঈদের পোশাক ও ২ বেলা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
বিশ্বজুড়ে চলছে করোনার থাবা। আঘাত লেগেছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও।কর্মহীন হচ্ছেন মানুষ। উত্তরের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর কষ্টটা একটু বেশিই। বিষয়টি ভাবিয়ে তোলে 'হেল্প'র নিবেদিত কর্মীদেরকেও। গত শনিবার ১শ' অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে দেন ১ সপ্তাহের খাবার। যাতে ছিল ৫ কেজি চাল, ২ কেজি আলু, ১ কেজি পিয়াজ, ১ কেজি ডাল, ১/২ কেজি তেল, ১/২ কেজি লবণ, ৪টি সাবান ও ১টি হ্যান্ড স্যানিটাইজার। পাশাপাশি করোনার থেকে বাঁচতে সচেতনতামূলক পরামর্শও প্রতিনিয়ত দিয়ে যাচ্ছেন তারা। 'হেল্প' দ্বিতীয় ধাপে প্রস্তুতি নিচ্ছে আরও শতাধিক মানুষের হাতে সাহায্য পৌঁছে দিতে।
'হেল্প'র সাবেক সভাপতি ডা. নাজমুস সাদিক অনিক বলেন, শীতে যখন গ্রামের বৃদ্ধ মানুষটা একটা কম্বল পেয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন এটাই আমাদের প্রাপ্তি। বন্যায় সব হারানো মানুষটা একবেলা পেট পুরে খেতে পারেন এটাই আমাদের তৃপ্তি। আমরা আপনার সহযোগিতায় করোনার প্রভাবে এই কর্ম হারানো মানুষদের পাশে ফের দাঁড়াতে চাই।
'হেল্প'র স্বপ্ন২০১০ সালে শীতার্তদের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই কাজ শুরু করি স্কুল বন্ধুরা। তখন কলেজে পড়তাম। প্রথম ৫শ' জন মানুষের মাঝে পুরোনো কাপড় বিতরণ করি। এরপর একটি সংগঠনের তাগিদ থেকেই 'হেল্প'র যাত্রা শুরু হয়। গত ১০ বছরে ১৭টি ইভেন্ট করেছি আমরা। বিস্তৃত হয়েছে কাজের পরিসর। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতেও নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে 'হেল্প' এমনটাই বলেন, 'হেল্প'র প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি ডা. সাব্বির আহমেদ।
তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে রংপুরের সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের জন্য স্কুল, দরিদ্র মানুষের স্থায়ী আয়ের ব্যবস্থা করাসহ অনেকগুলো স্বপ্ন আছে আমাদের। সহৃদয়বান, দানশীল কেউ এগিয়ে এলে সেগুলো দ্রুত পূরণ হবে নয়তো একটু দেরি হবে। তবে আমরা থেমে থাকবো না, স্বপ্ন পূরণে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
হেল্প'র সদস্যএই সংগঠনটির সঙ্গে জড়িত প্রায় ১শ' জন। যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী। এছাড়াও প্রায় ৩০ জন নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়াও এই মহত কাজে যোগ দিতে পারেন যেকেউ।
'হেল্প'র অর্থায়ন'হেল্প'র নিজস্ব কোন আয়ের উৎস নেই। অর্থ সংগ্রহের জন্য তারা ছুটে যান বিত্তবান ও পরিচিত স্বজনদের কাছে। এছাড়াও বিভিন্ন পরীক্ষা, উৎসবের দিনে অর্থ সংগ্রহের জন্য দাঁড়িয়ে পড়েন 'হেল্প'র সদস্যরা। 'হেল্প'র অনেক সদস্য অধ্যায়নরত আছেন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। চাকরিরও করছেন কেউ কেউ। এসব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের মাধ্যমেও অর্থ সংগৃহীত হয়।
'হেল্প'র সভাপতি ফাহমিদ হাসিব ফিয়ান বলেন, আমরা 'হেল্প'র মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া অসহায় লোকদের সাবলম্বী করে তুলবার চেষ্টা করছি। তাদের বিপদে একটু সহযোগিতার হাত বাঁড়িয়ে দিতে কাজ করছি। দাতাদের সহযোগিতা ও ভালোবাসা যোগ্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দিতে বধ্য পরিকর।
তিনি আরও বলেন, আমাদের কাজের পরিসর আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, বিত্তবানদের সহযোগিতায় আরও বড় পরিসরে করতে চাই।
অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে পারেন আপনিও। সাহায্য পাঠাতে বিকাশ নম্বর
01912823948, 01713 569941, 01713707978
01738789606 (রকেট)