২৮ বছর বয়সী গুলবাহার বেগম ২০১৭ সালের নভেম্বরের পর থেকে তার পিতার মুখটি আর দেখতে পান না। তার পিতা গুল মোহাম্মদকে বাড়ি থেকে ১৪৫ কিলোমিটার দূরে একটি বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি প্রতি মাসে একবার সোনিতপুর জেলার তেজপুর যান পিতার সঙ্গে দেখা করতে। ঘটনা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের। আসামের বিচার বিভাগীয় ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ৬৯ বছর বয়সী গুল মোহাম্মদকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে ঘোষণা করেছে। নাগরিকত্ব প্রমাণের যথাযথ কাগজপত্র না থাকায় এই দশা হয় মোহাম্মদের। গত তিন সপ্তাহ ধরে বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসজনিত মহামারির কারণে গুলবাহার তার পিতাকে মুক্ত করার জন্য আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলছেন, তার পিতার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ তাকে ঘুমাতে দেয় না।
আসামের মেরিগাঁও জেলার বরখাল গ্রামের বাসিন্দা গুলবাহার আল জাজিরাকে বলেন, আমার বাবার কিডনির অসুস্থতাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। তার বাম পা প্রায়শই ফুলে যায়। এই স্বাস্থ্য সংকটে তার বাড়িতে থাকার কথা ছিলো, কোনো আটক কেন্দ্রে নয়। ভারত মহামারি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু আসামের ছয়টি আটক কেন্দ্রে অনির্দিষ্টকালের জন্য যে ৮ শতাধিক ‘অবৈধ’ অভিবাসী আটক রয়েছে তাদের পরিবার প্রিয়জনদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। গত বছর প্রায় ১৯ লাখ মানুষকে এনআরসির মাধ্যমে রাষ্ট্রবিহীন হিসেবে ঘোষণা করে ভারত। এদের মধ্যে একটি বড় অংশই মুসলিম। তাদের হাতে দেয়া হয় দুটি সুযোগ। দেশ ছাড়তে হবে নইলে আটক কেন্দ্রে আটক থাকতে হবে। বেশ কয়েকটি অধিকার সংগঠন দাবি করেছে যে, এনআরসি ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপির মুসলিম জনগণকে রাষ্ট্রচ্যুত করার একটি অস্ত্র। তবে প্রথম থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আসামে আটককৃতদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আটককেন্দ্রে গাদাগাদি করে রাখার কারণে সম্ভাব্য করোন ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা রয়েছে। সেখানে স্বাভাবিক শারীরিক দূরত্ব রক্ষা করে থাকাও অসম্ভব। বেশিরভাগ কেন্দ্রে আটক ব্যক্তিদের জন্য সঠিক স্বাস্থ্যবিধি এবং চিকিত্সা যত্নের অভাব রয়েছে। এটি মহামারি সংক্রমণের সম্ভাবনা আরো বাড়িয়ে তোলে। গুলবাহার জানান, সাধারণ হলগুলিতে মানুষ দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। একটি ঘরে কমপক্ষে ৫০ জনকে রাখা হয়। এমন অবস্থায় থাকা তাঁর বাবার জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এর আগে ২০০৯ সাল থেকে আটক কেন্দ্রের অভ্যন্তরে অন্তত কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছেন। সর্বশেষ রবিবার একটি প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। প্রতিবেদনে রাবেদা বেগম নামের ওই নারীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে উল্লেখ করা হয়েছে। একইরকম আশঙ্কা কাছার জেলার বাসিন্দা বটু মিয়ার (৪০)। তিনি শঙ্কিত যে, শিলচর আটক কেন্দ্রে রাখা তার স্ত্রী বানেসা বেগম করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন। ৪৫ বছর বয়সের দিনমজুর বানেসাকে প্রথমে ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রয়োজনীয় প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় 'সন্দেহজনক ভোটার' হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। পরে তাকে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৭ সালে সন্দেহজনক ভোটারদের ভোট প্রদানের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। এরপর থেকে প্রায় ১,৪৩,০০০ মানুষ সন্দেহজনক ভোটার হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। ট্রাইব্যুনালগুলি থেকে জানানো হয়েছে, তাদের অনেকে মূলত বাংলাদেশ থেকে আগত কথিত 'অননুমোদিত' অভিবাসী। ফলে অনেক সন্দেহজনক ভোটারই শেষ পর্যন্ত আটক কেন্দ্রে আটক রয়েছেন। বটু মিয়া আল জাজিরাকে বলেন, আটক শিবিরগুলির অবস্থা অমানবিক। এগুলোতে নেই কোনো বিছানাপত্র ও শৌচাগারের মতো মৌলিক সুবিধা। এই রোগের মধ্যে তার স্ত্রীকে এমন জায়গায় রাখা বিপজ্জনক। যদিও সোনিতপুর জেলার জেলা প্রশাসক মনবেন্দ্র প্রতাপ সিংহ প্রতিটি বন্দির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। সিং আল জাজিরাকে বলেন, আমরা নতুন কয়েদিদের নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। প্রত্যেককে নিয়মিত চিকিত্সকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। এবং এখানে করোন ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কোনো সম্ভাবনা নেই। এদিকে কিছু পরিবার আটক কেন্দ্রগুলির অভ্যন্তরে ভাইরাসটি একটি মহামারিতে পরিণত হওয়ার আগেই আদালত থেকে জামিন পাওয়ার জন্য মরিয়া চেষ্টা করছে। বাক্সা জেলার গোবর্ধনা গ্রামের অনুরা বেগম (৩১) গোয়ালপাড়া কেন্দ্রে থাকা স্বামী কদম আলীকে জামিনে নেওয়ার জন্য সমস্ত নথি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু রাজ্যজুড়ে আদালত করোনভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পরে গত মাসে কার্যক্রম স্থগিত করেছে। অনুরা বেগম আল জাজিরাকে বলেন, লকডাউনের ঠিক আগে আমি আমার স্বামীর জামিনের জন্য নথি জমা দিয়েছিলাম। কর্মকর্তারা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেন এবং আমাকে অতিরিক্ত নথিপত্র জমা দিতে বলেন। তবে এখন আদালত বন্ধ রয়েছে এবং আমি জানি না তার কী হবে। একইভাবে বরপাটা জেলার শাতভরিধুক গ্রামের বাসিন্দা অনুরা আলীও আদালত খোলার অপেক্ষায় রয়েছেন। তার আশা, তিনি তার বাবা হানিফ আলীকে জামিনে মুক্তি দিতে পারেন। আলী আল জাজিরাকে বলেন, প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য নতুন ট্র্যাজেডি নিয়ে আসে।