× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ছোট বেলায় মহামারিকে যেমন জেনেছি

মত-মতান্তর

জহির আহমেদ, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা
১৩ এপ্রিল ২০২০, সোমবার

ছোট বেলায় দুটো মহামারিকে দেখেছি—কলেরা মহামারি আর গুঁটি বসন্ত মহামারি। নাম মুখে আনা বারণ ছিল। ‘অসুখ’ ‘বলা’ ডাকা হত। আজও মনে পড়ে, মায়ের বুকে লুকিয়ে থাকতাম। মশারী ফেলে রাখা হতো চব্বিশ ঘণ্টা। গভীর রাতে সুনসান নীরবতায় কুকুরের কান্নার সূর সবাইকে ভীত সন্ত্রস্ত করে রাখত। এই বুঝি বলা আসছে— গোপনে, বাতাসে, দেও এর মাধ্যমে। যে পাপ করেছে মানুষ, তার কাফ্ফারা হিসেবে এই মহামারি।
নিরাময়ের জন্যে কিছু ব্যবস্থা নেবার কথা মনে আছে। হুজুরের পড়া পানির ঝিটকা দেয়া হতো শরীর আর ঘরে বাইরে। মা, আমাদের ঘরের মূল ফটকে বেড়ার সাথে নিম গাছের ডাল লাগিয়ে রাখতেন। উদ্দেশ্য ছিল বলা-মুসিবত/ আলগা বাতাস যেন ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। মা প্রতিদিন সাদা বেলে মাটি দিয়ে ভিটার ডেলা লেপ দিতেন— একটা নান্দনিক শিল্পের ছাপ থাকত। দীর্ঘদিনের পরিচিত নারী ভিক্ষুকদেরকে ভিক্ষা দেয়া হতো না। আমাদের কাছারি ঘরের কাছ পর্যন্ত নারী-পুরুষ ভিক্ষুকরা দাঁড়িয়ে মুষ্টি চাল ভিক্ষা চাইতো। আমাদের গ্রামের পীর এর বংশদবদ হেকিম সাহেবের লাল মিকচারের দাওয়াই দেয়া হতো। আজও মনে পড়ে, মা দৌড়ে গিয়ে জ্বর সারানোর জন্যে গায়ে সরু সাদা কাগজের থরে থরে দাগ কাটা ছোট বোতলের মিকচার আর কতক পুরিয়া পাউডার নিয়ে আসতেন। ‘আল্লাহ শাফি’ করে মা খাওয়াতেন। মশারির ভেতরে থেকেই পথ্য আর খাওয়া দাওয়া চলতো। মা-ই লোকমা ধরে ধরে খাওয়াতেন। করলা ভাজি ছিল গরম ভাতের সাথে প্রধান তরকারি। আহা, মায়ের হাতে কত থাপ্পর ই না খেয়েছি ওই তিতা করলা না খাবার জন্যে। কালি জিরার ভর্তা না খেলে বলা যাবেনা--বলা মুক্তির জন্যে-স্বর্গীয় মায়ের আশার বানীর কথা এই করোনা ভাইরাস সংকটে বার বার মনে পড়ে। মুড়ি আর চিড়া খেতাম সুস্বাদু নারকেলের সাথে। মধু ছিল আর এক প্রয়োজনীয় উপকরণ।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের চার গ্রামের অতন্দ্র প্রহরি ময়রার বাপের কথা। ছোট খাট পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব এই কাকা আমাদের কে রমজানের সেহরির সময় টিনের চুঙ্গা ফুকে এ পাড়া থেকে ওই পাড়ায় গিয়ে ঘুম থেকে উঠাতেন। একইভাবে ওই দুটো মহামারির সময় সম্প্রদায় লেভেলে ময়রার বাপের ভুমিকা খুব মনে পড়ে। এই দুর্যোগের রাতে তিনি বাড়ি থেকে বাড়ির সদর ফটকে গিয়ে সবাইকে মহামারি থেকে সাবধানে থাকার কথা বলতেন। গভীর রাতে এই পাড়া ওই পাড়ায় আজান দিতেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার কথা বলতেন; ধর্ম কর্ম পালন করার কথা বলতেন। যে যা পারে তার থেকে টাকা উঠাতেন। একটা ‘পঞ্চায়েত ফান্ড’ তৈরি করতেন গরীব হতভাগ্যদের জন্যে যাদের পরিবারের দাফন করার সামর্থ্য ছিলনা। আমার কল্পনায় এখনো দেখতে পাই মশারীর নিচে মমতাময়ীর হাতের পরশ নিচ্ছি আর ইথারে ময়রার বাপের চুঙ্গা ফুকানোর বানী শুনছিঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ইল্লাল্লাতে নূর, পাক মুখে বলি আল্লাহ্ বলা কর দূর”। ভাবছি, বহু মহামারি সংকট আমরা অতিক্রম করেছি। এখনও করব ইনশাল্লাহ। ভাবতে ভাবতে কেন জানি চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

(লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং অভিবাসন ও সীমান্ত বিষয়ক টাস্কফোরস সদস্য, আমেরিকান এন্থ্রোপলজিকাল এসোসিয়েশন। )
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর