‘মরমু বইলা করমু না কাম, বাঁচলে খামু কী?’ বরিশালের এই প্রবাদের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন করোনায় বেঁচে গেলেও জীবনকে যাপন করার কামড় থেকে তারা কিভাবে বাঁচবে! কৃষিপ্রধান এ দেশে শুধু ত্রাণ দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মতো ঘরে থেকে সবার জীবন চলবে না। দূরত্ব বজায় রেখে, করোনায় কর্মশক্তি ও চিন্তা শক্তি না হারিয়ে শরীর ও মনটাকে কাজ দিতে হবে। প্রকৃতির সাথে শরীরের অভিযোজন না ঘটাতে পারলে শুধু ঘরে বসে থেকে লাভ হবে না, আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখার জন্য যুব সমাজের অনেক বেশি ভূমিকা আছে, তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ দিতে হবে। এখন থেকে মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে এ অঞ্চলের মানুষের করোনা সমস্যার সমাধান আমাদের দেশের অতীতে মহামারী ও দুর্ভিক্ষ থেকে উত্তরণের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতেই এগিয়ে যেতে হবে, ইউরোপীয় পদ্ধতিতে সব সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে না।
এখন দেশের মানুষের সংকট ৩টি। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ভয়, করোনায় আয় রোজগার বন্ধ হয়ে নি¤œবিত্ত মানুষের মৃত্যু শঙ্কা। করোনার কারণে গৃহবন্দী হয়ে অন্য রোগে আক্রান্ত হওয়া মানুষের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুর শঙ্কা।
সম্প্রতি ব্র্যাকের পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ মানুষের দাবি, করোনা ভাইরাসে ঘরে থাকা সাধারণ মানুষ সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না। সরকারের জরুরি ত্রাণ পৌঁছেছে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের কাছে। সুতরাং সরকারকে শুধু করোনা মোকাবেলা করাই একমাত্র সমাধান না ভেবে এর পাশাপাশি মানুষের খাদ্য সংকট নিয়ে ভাবতে হবে।
মধ্যযুগের সুলতানি আমলে মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহগুলো ছিলো দরিদ্র, নিঃস্ব, সন্ন্যাসী ও ভবঘুরে সব মানুষের জন্যই উন্মুক্ত। সুফিদের দরগাহগুলোকে দুনিয়ায় বিশ্রামদানকারী অট্টালিকারূপে বিবেচনা করা হতো, যেখানে জনসাধারণের আশা পূর্ণ হতো। এখন সময় এসেছে তাদের জীবনাচারকে অনুসরণ করার।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ছিলো ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। ১৭৭০ সালে বাংলার এই দুর্ভিক্ষে প্রায় এক কোটি মানুষ খাবারের অভাবে মারা যায়, যা ছিল সমগ্র বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণায় প-িতদের দাবি, খাদ্যের অপর্যাপ্ততার কারণে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়নি বরং বিতরণ ব্যর্থতার কারণে হয়েছে। তখন একদল ‘বাজারে খাবারের ওপরে আধিপত্য স্থাপন’ করেছিলো। খাদ্যশস্য মজুতের সরকারি অব্যবস্থাপনা, জেলাগুলির মধ্যে খাদ্যশস্য আনা-নেয়ার সীমাবদ্ধ আইন, প্রতিবেশী দেশগুলিতে খাদ্যশস্য চোরাচালান এবং তথাকথিত বিতরণ ব্যর্থতার কারণে এ দুর্ভিক্ষ বলে মনে করেন গবেষকরা। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি কৃষিকে ধারণ করেই। এদেশের ধর্মও কৃষিকাজকে উৎসাহিত করে। তাই করোনা মোকাবেলায় সামনে যেন দুর্ভিক্ষ না আসে তার মোকাবেলায় নি¤েœাক্ত প্রস্তাবনা পেশ করছি।
১. এ বছর কৃষি বিপ্লব ঘটাতে হবে, বাসার বারান্দা, ছাদ থেকে শুরু করে যেখানে সুযোগ থাকবে সেখানেই কোন না কোন শাক, সব্জি, ফসল ফলানোর ব্যাপারে রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।
২. মাছ চাষ, গবাদি পশু পালন, কৃষিকাজে শিক্ষিত তরুণ ও যুবকদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তাদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে।
৩. কৃষির উন্নয়নে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের বিষয়ে নজর দিতে হবে।
৪. মসজিদগুলো বন্ধ না রেখে যাদের মাথা গোঁজার ঠাই নেই, তাদেরকে এখানে হোম কোয়ারেন্টিনে রেখে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদারকিতে খাওয়া, থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. প্রতিটি ইউনিয়নে কৃষি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্ববধায়নে কৃষি উন্নয়ন সমবায় সমিতির অফিস থাকবে। সেখানের স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে সেই এলাকা উপযোগী শস্য তৈরির নির্দেশনা ও এর দাম নির্ধারণ করে দেবে সরকার এবং উৎপাদিত পণ্য সেখান থেকে সরকার কিনে নেবে।
৬. গার্মেন্টসসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাকরি হারানো মানুষদের এই কৃষিকাজে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ পাবে।
৭. সেনাবাহীনিকে কৃষি উৎপাদন, বাজারজাতকরণে সম্পৃক্ত করতে হবে, যেন এ খাতে কোনো অশুভ শক্তি কিংবা কোনো অব্যবস্থাপনা না হয় তা নিশ্চিত হয়।
৮. কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষকে ঘরে বসিয়ে না রেখে সামাজিক দূরত্ব মেইনটেইন করে কিভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে নির্দেশনা দিতে হবে। সে সঙ্গে ইতিমধ্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য যেন ন্যায্যমূল্যে বিক্রি হয়, সেজন্য প্রত্যেক ইউনিয়নে পণ্যে সংরক্ষণাগার ও গুদামজাতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. যারা ঘরে থাকেন তারাও যেন কোনো না কোনো প্রশিক্ষণ, শরীরচর্চা, বইপাঠে থাকেন- সে বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
১০. ছিয়াত্বরের মন্বত্ত্বর ও চুয়াত্ত্বরের দুর্ভিক্ষ থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে যেন, খাদ্যশস্য মজুতের সরকারি অব্যবস্থাপনা না হয়, মুনাফাখোর, অতিলোভী কেউ যেন বেশি দামের আশায় পণ্য লুকিয়ে না রাখে।
১১. ভেষজ চিকিৎসা, ইউনানী ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের সরকারকে আমলে নিতে হবে। এ দুর্যোগে অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার এর পাশাপাশি তারা যেন স্থানীয় মানুষকে অন্যান্য রোগের চিকিৎসাসেবা দিতে পারে সে বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে।
১২. ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, লবণ মিশ্রিত গরম পানি দিয়ে গারগোল এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাবান দিয়ে হাত ও ব্লিচিং দিয়ে বাড়িঘর পরিষ্কার রাখার বিষয়ে প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে।
(লেখকঃ শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।)