হইচই আর চেচামেচিতে হাওয়ায় মিইয়ে যাচ্ছে হাওয়া বেগমের বোবা কান্না। চোখে দেখছেন গাঢ় অন্ধকার। পেটে পড়ছেনা দানাপানি। আজ সকালে কোলের সন্তানকে নিয়ে বেরিয়েছেন কোথাও ত্রাণ পওয়া যায় কিনা সে আশায়। দুদিন ধরে কয়েক জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু টোকেন না থাকায় ত্রাণ মেলেনি। কদমতলী থানার জনতাবাগ চৌরাস্তার একপাশে নীরবে দাড়িয়ে চোখের পানি ফেলছেন। একটু দূরে আফরানা স্টোর।
সেখানে মালামাল কেনার লম্বা লাইন। পাশের বউ বাজারেও ভিড়। হাওয়া বেগম এসব দেখেই চোখের জল ফেলছেন। বলেন, এখানেই গত চার পাঁচ দিন ধরে ত্রাণের লিস্টে নাম উঠাতে ছিল লম্বা লাইন। কয়েক জায়গায় ত্রাণ নিতেও ছিল মানুষের ভিড়। হুড়োহুড়ি থামাতে পুলিশকে অ্যাকশনেও যেতে হয়েছে। কত জনের কাছে গিয়েছি একটা ত্রাণের টোকেন দিতে। কেউ দেয়নি। কোথায় বাসা জানতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। হাওয়া বেগম বলেন, দুই মাস আগেও আমার অভাব ছিলনা। স্বামী শহিদুল আলম চায়ের স্টল চালিয়ে ভালই ইনকাম করতেন। আর আমি তিতাস গ্যাস রোডের কিন্ডারগার্টেন স্কুল কসমিক ন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করি। মাসে দেড় হাজার টাকা বেতন পেতাম। এছাড়া টিউশনি করে আরও পাঁচ হাজার টাকা পেতাম। কিন্তু করোনার থাবা আমার সংসারটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। স্বামীর দোকান বন্ধ। আমারও স্কুল বন্ধ থাকায় দুই মাস ধরে বেতন পাচ্ছিনা। আর যাদের প্রাইভেট পড়াতাম তারাও এ অবস্থায় আসছেনা। গ্যাস রোডের ১১৪ নাম্বার বাড়িতে ছোট একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করি। এতোদিন কোনরকমে চললেও এখন আর পারছিনা। লজ্জা শরম ত্যাগ করে এক ছাত্রের মাকে ঘরে খাবার না থাকার কথা জানাই। তিনি চাল,ডাল, চিনি, আলু, চিড়াসহ নানা পণ্যের একটি ব্যাগ পাঠান। সেসবও শেষ। চোখের সামনে মানুষজন বাজার করে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ ত্রাণের ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। আমি ফিরব খালি হাতে। তিন সন্তানের মুখে দুপুরে কি দেব? কেঁদে ফেলেন শিক্ষিকা হাওয়া বেগম। জানান, লোক লজ্জায় স্বামীও কোথাও হাত পাততে পারছেনা।
একটু সামনে এগিয়ে আফরানা স্টোর। রমজানের ইফতার সামগ্রী কিনতে মানুষের ভিড়। চার পাঁচজন কর্মচারীর ফুরসত নেই। ক্যাশে বসা দোকান মালিক আলী হোসেন দুই হাতে বিক্রিত পণ্যের টাকা নিচ্ছেন। তিনি বলেন, বেলা দুইটায় দোকান বন্ধ করতে হয় বলে ভিড় লেগেই থাকে। তিনি বলেন, এই একটি এলাকা দেখলেই গোটা দেশের চিত্র উঠে আসবে। দেখুন একদিকে ত্রাণের জন্য হাহাকার। দরিদ্রদের সঙ্গে যোগ হয়েছে বহু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার। যারা কারো কাছে কখনো হাত পাতেনি। ইদানিং এমন অনেকে আসেন বাকিতে মালামাল নিতে। নানাভাবে অনুরোধ করেন। অথচ তাদের সবসময় আমার দোকান থেকে মালামাল নগদে নিতে দেখেছি। এখন যখন বাকির জন্য অনুনয়, বিনয় করেন অনেককে ফিরিয়ে দিতে পারিনা। যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করছি। কিন্তু পরিস্থিতি ভাল মনে হচ্ছেনা। করোনা সবকিছু উলট পালট করে দিচ্ছে। গ্যাস রোডের ছয় নং গলির যুবক রুবেল। এ গলিতে তাদের নিজের বাড়ি। রুবেল গ্রীলের মালামাল অর্ডার নেন। তৈরি করে দেন। বাড়ির নিচ তলায় তার কারখানা। মাস দেড়েক ধরে তার কাছে কোন অর্ডার নেই। ফলে উপার্জন একেবারে বন্ধ। রুবেল কদিন বউ বাজারে ফল নিয়ে বসেন। বলেন, কদিন খেয়ে না খেয়ে দিন পার করেছি। আর পারছিনা। তাই ফল নিয়ে বসেছিলাম। এখন দেখি আমার মতো অনেকেই ফলের ব্যবসা দিয়ে বসেছে। কিন্তু কেনার লোক কম। তাই আজ মুরগি নিয়ে এসেছি বাজারে। পরিচিতজনদের অনুরোধ করছেন তার কাছ থেকে মুরগি নিতে। কাউকে কাউকে মোবাইল ফোনে অনুরোধ করছেন। ৮৫/১ জনতাবাগের বাসিন্দা আকবর বলেন, বিশেষ করে কাজের বুয়াদের অবস্থা খুবই করুন। করোনা থাবা মেলার পর ৯০ ভাগ কাজের বুয়াকে পাওনা দিয়ে বাদ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কাজে এসে যোগ দিতে। এরা এখন ত্রাণের জন্য এখানে ওখানে ছুটাছুটি করছে। আকবরও ব্যবসা করেন। ছোট একটি কারখানা আছে ইলেক্ট্রিক মালামাল তৈরির। ছুটি ঘোষনার পর থেকে তার কারখানার চাকাও বন্ধ। সায়েদাবাদ টাইলসের ব্যবসা করেন হাসান আহমেদ। প্রায় দুইমাস তার দোকান বন্ধ। হাসান বলেন, দোকান বন্ধ হলেও খরচতো কমেনি। দেকান ভাড়া ও কর্মচারীর বেতন দিতে হচ্ছে মাসে দেড় লাখ টাকা। সংসার খরচতো এক পয়সাও কমেনি। এভাবে আর চলতে পারছিনা। কদমতলী থানার পাশে কসমেটিক্সের ব্যবসা করেন মো. ইব্রাহিম। কেমন চলছে জিজ্ঞেস করতেই বলেন। মানুষ এখন খাবারই পাচ্ছেনা। রুপ চর্চার সময় কোথায়? রাস্তার পাশে মাথা নিচু করে বসে আছেন ষাটোর্ধ জমসেদ। কাছে যেতেই মাথা তুলে থাকালেন। বিষন্ন, বিবর্ণ মুখ। কেমন আছেন? কেঁদে দিলেন। বললেন, ভ্যান চালাই। গত দেড় মাসে মাত্র তিনদিন ভ্যান চালাতে পেরেছি। বাকি দিনগুলো এভাবে বসে বসে কাটিয়েছি। ঘরের অবস্থা বলতে চাইনা। গ্রামের বাড়ি রাজবাড়ি জেলায়। ঢাকায় রায়েরবাগের ৮২ জনতাবাগ বাড়িতে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে বসবাস করি। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। আরেক মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত। জমসেদ বলেন, করোনা গজব থেকে কবে মুক্তি পাবো জানিনা। ঘরে গেলে মেয়েটার মুখের দিকে থাকাতে পারিনা। পেট আর পিঠ মিশে গেছে। বাবা হয়ে এ দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। অনেক কষ্টে দিন চলছে। এর চেয়ে বাড়ি চলে গেলে অনেক ভাল হত। মরলেও আপনজনদের সামনে মরতে পারতাম। কেন গেলেন না? জমসেদের কথা- বুঝতে পারিনি এমনটা হবে।