একদিকে রবীন্দ্র সরণির ঘিঞ্জি রাস্তা, অন্যদিকে ফিয়ার্স লেন, কলুটোলা মার্কেট। তারই মাঝখানে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে নাখোদা মসজিদের সুউচ্চ মিনারগুলো। এই নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন রাস্তার নামই হলো জাকেরিয়া স্ট্রিট। প্রতিবছর রমজান মাসে যে রাস্তা রাতে কখনো ঘুমায় না। ষাট ন্যানোমিটারের একটি ভাইরাস এবার সব কিছু বদলে দিয়েছে। রমজান মাসে জাকেরিয়া স্ট্রিট রমরম করে প্রতিবার। বসে বাজার। এবার প্রায় শুনশান জাকেরিয়া স্ট্রিট।
আতরের খুশবু তে চারদিক সুগন্ধে ভেসে যাচ্ছেনা। হালিমের মাতানো গন্ধ মনকে মত্ করে দিচ্ছে না। জাকেরিয়া স্ট্রিটের মনখারাপ এখন। নাখোদা মসজিদের মাইকে আজানের সুর ভেসে আসে। কিন্তু তাতে মেশে পুলিশের টহলদারি ভ্যান এর ঘড়ঘড় আওয়াজ। বুট এর শব্দ। আগে শেষরাতে সেহরির আগে ব্রেকফাস্ট এর নানা পদে নিজেদের জারিত করে নিতো মানুষ দীর্ঘ উপবাসের জন্যে। কান পাতলে ডিম ফাটাবার শব্দ মিলতো। এখন নিকষ কালো রাত্রির শুধু অসীম নিস্তব্ধতা। জাকেরিয়া স্ট্রিট বিখ্যাত তার রফম্যানের বাজারের জন্যে। নাখোদা মসজিদের উল্টোদিকে সারি সারি আতরের দোকান। সেই দশম শতাব্দীতে পারস্যের পদার্থবিদ ইবন সিনা আবিষ্কার করে গেছেন ফুলের নির্যাস থেকে এই মনকাড়া সুগন্ধী। আজও তা জাকেরিয়া স্ট্রিট কেন, গোটা বিশ্বের অলংকার। জাকেরিয়া স্ট্রিটে কুড়ি টাকা শিশির আতর যেমন বিক্রি হয় তেমনই কুড়িহাজার টাকা বোতলের। লকডাউনে সব বন্ধ। সেই কবে আরব সেনারা হায়দরাবাদ ন্যাশনাল রেজিমেন্টে দাখিল হয়ে হালিম খাওয়ার প্রচলন করেছিল। আজ সেই হালিম উপবাসের পর দারুন সুখাদ্য। গম, বার্লি, ডাল আর মাংস দিয়ে তৈরি হালিমের গন্ধে ম ম করে জাকেরিয়া স্ট্রিট। আজ একদম কিছু নেই। নেই ইফতারের পর চ্যাঙ্গেরি চিকেন, ভাজা মাছের মাহি আকবরি, বাখরখানি রোটি, লাড্ডু, গুলাবজামুন কিংবা মাস্কাট হালুয়া। শেরওয়ানি চোস্ত আর ফেজ টুপির দোকানে ঝাঁপ বন্ধ। সম্পন্নরা রমজানের সময় উপহার দেওয়ার জন্যে কিনতেন গোলাপ, লিলি কিংবা অর্কিড। সেই টাটকা ফুলের দোকানে মলিন ধুলোর ছাপ। কেউ আর দোকান খোলে না। কেউ আসেনা ফুল কিনতে। বড় বেশি নিস্তব্ধতা। করোনা যেন সব প্রাণ শুষে নিয়েছে। জাকেরিয়া স্ট্রিটে অলিগড়ি পাজামার দোকানের সামনের ফুটে মলিন বসন পরে বসে আছে এক ভিখারি। তাকে আজ ফুটো পয়সা দেওয়ার জন্যেও কেউ নেই। সে কি ভাবছে সর্বশক্তিমানের থেকেও এই ভাইরাস এর ক্ষমতা বেশি নাকি এটাও তাঁর এক খেলা, মানুষকে সবক শেখানোর জন্যে?