× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৮ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অস্তিত্বের সংকট

মত-মতান্তর

বিল্লাল বিন কাশেম
২৩ মে ২০২০, শনিবার

জগৎ সংসারের প্রতি অনিহা ক্রমশই বাড়ছে। নারী জাতির নিজের জগৎ বলতে বাস্তবিক কোনো জগত আছে বলে নেহা মনে করে না। এ সমাজে নারীর কাজ হচ্ছে স্বামীর মনোরঞ্জন করা, সন্তান উৎপাদন ও লালন-পালন করে মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখা এবং গৃহের সাংসারিক কাজ করা। পুত্রসন্তান জন্মদানে ব্যর্থতার দায় যে কোনো নারীকে সারাজীবন বহন করতে হয়। যদিও স্বামীর শুক্রাণুর অক্ষমতাই দায়ী সন্তানের পুত্রের লিঙ্গ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। কন্যাসন্তান বংশের বাতি বিনির্মাণের অন্তরায় - এমন বদ্ধমূল অনিয়মতান্ত্রিক প্রথা সমাজে কোনো এক অন্ধগলি দিয়ে প্রবেশ করেছে এবং এখনো তা আমাদের মনোজাগতিক কেন্দ্রে টিকে আছে আবহমানকাল থেকে। পুত্রসন্তানই, সে বলদ আর বুদ্ধিমান যাই হোক তা পিতৃবংশের আলোকবর্তিকা এমনই রগরগে অবুঝ নীতি সমাজে বারবার ঠোঁকর দিচ্ছে।

নেহা এমন সমাজব্যবস্থার একজন মেয়ে যে কিনা পিতা-মাতার বংশরক্ষার অপ্রত্যাশিত খসেপড়া তারার মতো পৃথিবীতে এসেছে। ব্যর্থ প্রচেষ্টার তারাটি নেহা তার বাবা-মা'র কাছে সন্তানের মতোই মানুষ হচ্ছে।
নেহার বাবা-মা'র প্রথম কন্যাসন্তান। নেহার বাবা তার বংশ রক্ষার বাররার প্রচেষ্টায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে স্ত্রী-মেয়েদেরকে নিয়ে বাপ-দাদার ভিটায় বসবাস করে। নেহা ও তার দুই বোন নিয়ে বসবাস করে তার বাবার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বসত বাড়িতে। তিন-তিনটে সিজাররিয়ান কন্যাসন্তান জন্ম দিয়ে নেহার মা আর নতুন করে ঝুঁকি নেয়নি বংশের সমুজ্জ্বল তারকা বিনির্মাণে। তবুও নেহার মা'কে চারপাশের অযাচিত তীব্র খোঁচা আক্রান্ত করে। পুত্রসন্তান জন্মদানের ব্যর্থতার দায় তার একার-এমন খোঁটা তার শুনতে হয়।

নেহার বাবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে ভাগ্যের চাকা সচল করার জন্য পাড়ি জমায়। তিন-তিনটে মেয়েকে সুপাত্রস্থ করার জন্য তার এ প্রবাস জীবন। প্রবাস জীবনে বছর দু'য়েক কাটিয়ে ছুটিতে বাড়িতে আসে নেহার বাবা। সে বাড়িতে এসে অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাঁচা-মরার মধ্যেখানে অসহায়ত্বের অস্তিত্ব নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তার বাবা সংসারের এমন পরিস্থিতিতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সংসারেও তেমন আশার আলো জ্বলে না। তিন বোনের লেখাপড়া, সংসার ও বাবার চিকিৎসার খরচে সংসারটিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। আশেপাশের লোকজন ও আত্মীয়-স্বজনের বিমুখতাও উক্ত সংসারটির চক্রাটি নোনাজলের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

নেহা আস্তে আস্তে নিজের জীবনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে বাবা-মা'র উদ্বিগ্নতা উপলব্ধি করে। নেহা তাই বাবা-মা'র গণ্ডির মধ্যে আরো কিছুদিন প্রকৃতির সতেজতা নিয়ে বেড়ে উঠতে চায়। এই মুহূর্তে তাদের কাছে বড়ো সন্তান হিসেবে তারই গুরুত্ব বেশি। কিন্তু নেহা তার বাবা-মা যে তাকে উদ্ধার প্রক্রিয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে তা কিছুটা আঁচ করতে পারে। একদিন নেহা চুপিচুপি শুনতে পায় নেহার বাবা নেহার মাকে বলছে, 'নেহার মা, নেহাকে এ সংসারে বাঁধন থেকে মুক্ত করে নতুন বাঁধনে যুক্ত করো। কেননা আমার জীবনের মুক্তি যে কোনো সময়ে এসে যেতে পারে।' নেহার বোঝার আর বাকি থাকলো না যে কী হতে যাচ্ছে। নেহা নিজের সাথে নিজের আলাপে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, 'এ সংসারের বাঁধনে বাবা-মা ও দুই বোনের কাছে আর আমি কোনো গুরুত্ব বহন করবোনা। তারা তাদের বাঁধনের রশিটি কেটে দিয়ে দিবে। নতুন কোনো রশি দিয়ে অজানা কেউ এমন শক্ত করে বাঁধবে যেখানে পুরোনো রশিটি তার বাঁধনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।'

কোনো একদিন স্কুল থেকে ফিরে নেহা দেখলো যে, বাড়িতে অজানা চার-পাঁচজন লোক বসার কক্ষে বসে আছে। নেহার মা নেহাকে বলল, 'তোমাকে ছেলে পক্ষ থেকে দেখতে আসছে। চলো, একটা শাড়ি পরো। ওরা যা যা জিজ্ঞেস করে তার সুন্দর করে গুছিয়ে উত্তর দিবে।' নেহা মনে মনে ভাবে,'জীবন এই প্রথম শাড়ি পরতে বলল মা। তাহলে কি এই শাড়িই আমাকে মেয়ে থেকে নারীতে রূপান্তরিত করবে। আমি কি আমার মায়ের মত সেই জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। মায়ের জগতটি তো বড়োই নির্মম ও কষ্টের। আমি কি তাহলে মাকেই প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছি?'

নেহার দেখলো সাতাশ বছরের এক যুবকসহ কয়েক জনের সামনে একটি হলুদ শাড়ি পরিধান করিয়ে হাজির করলো। মাথায় গোমটা দিয়ে হাজির করা হলো কিশোরী মেয়েটিকে। এখানে নেহা ভাবলো যে তাকে পরিপূর্ণ একটি পরীক্ষা দিতে হবে। এ পরীক্ষা সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে দেয় যা সে অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পড়েছে। কোরান পাঠ পারে কিনা, রন্ধন শিল্পে হাত পাকা কিনা জানতে চায়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নেহা নতুন জগতে প্রবেশের সনদ পেলো ছেলেপক্ষ থেকে।

কোনো এক দিনে কিশোরী মেয়ে নেহার মৌনী সম্মতি ছাড়াই ঘনঘটা করে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেপক্ষ। নেহার বাবা মা প্রথম সন্তানের বিয়ে উপলক্ষে প্রয়োজনীয় অলঙ্কার, আসবাবপত্র ও কিছু নগদ অর্থের বিনিময়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে। কিশোরী মেয়েটি নেহা নববধুর সাঁঝে অজানা এক ছেলের সাথে পাড়ি দিল অজানা ভুবনে। নেহা প্রচন্ডভাবে ভাবে, 'আমি পরিচিত ঘর, পরিচিত মানুষ ও পরিচিত পরিবেশ থেকে আসলাম অপরিচিত ঘরে, অপরিচিত মানুষ ও পরিবেশে।আমার শরীর পরে আছে মহাজগতের নতুন বৃত্তে আর আমার ভিতরের আত্মা ঘুরছে সেই পুরনো বৃত্তে।' নেহার স্বামীর নতুনত্ব ও অপরিচিত কণ্ঠ আস্তে আস্তে পরিচিত হচ্ছে। নেহা মনে মনে ভাবছে, 'বৃত্তের মাঝে আমার জীবন বন্দিদশায় ঘূর্ণায়িত হচ্ছে।'

বিল্লাল বিন কাশেম
কবি ও গল্পকার।
[email protected]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর