× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ইতিহাসের সাক্ষী: কেমন ছিল নেলসন ম্যান্ডেলার কারামুক্তির দিনটি?

অনলাইন


(৩ বছর আগে) মে ২৫, ২০২০, সোমবার, ১২:০৭ অপরাহ্ন
মুক্তির পর গাড়িতে করে যাচ্ছেন নেলসন ম্যান্ডেলা

দীর্ঘ ২৭ বছর বন্দী থাকার পর ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আজীবন লড়াই করেছেন তিনি। তার মুক্তির এই দিনটির জন্যে দক্ষিণ আফ্রিকার লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ অপেক্ষা করছিল। এর মধ্য দিয়েই দেশটিতে অবসান ঘটতে শুরু করে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা শ্বেতাঙ্গ শাসনের।

ঐতিহাসিক সেই দিনটির কথা স্মরণ করেছেন তারই এক রাজনৈতিক সহকর্মী ভ্যালি মুসা। তিনি জানান, নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তির ব্যাপারে তাদের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। এজন্য তাদেরকে খুব দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল। কিন্তু সবকিছু যে সেই পরিকল্পনা মতোই হয়েছে তা নয়।

তিনি জানান, মাত্র একদিন আগে তাদেরকে জানানো হয় যে নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হবে।

"দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। এবং অবশ্যই বলতে হয় যে আমরা এর জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।"

এক সপ্তাহ আগেও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় নিষিদ্ধ ছিলেন। এমনকি বাড়ি থেকে বের হওয়ারও অনুমতি ছিল না তার।
কিন্তু হঠাৎ করেই তারা দেখলেন সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে।

১০ই ফেব্রুয়ারি ছিল শনিবার।

তিনি বলেন, "সেদিন সকালে সরকার আমাদের সাথে বৈঠক করার কথা জানালো। আমরা ছোট্ট একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে সেখানে গেলাম। সরকার বললো, তারা আমাদের জানাতে চায় যে আগামীকাল অর্থাৎ পরদিন নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হবে।"

"১১ই ফেব্রুয়ারি রবিবার, ১৯৯০ সাল, সকাল এগারোটায়। তারা বললেন, নেলসন ম্যান্ডেলা চান মুক্তির পর তাকে যেন কারাগারের গেটে তার কমরেডদের কাছে তুলে দেওয়া হয়। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এজন্যে আমাদের কোন প্রস্তুতি ছিল না। তখন সবকিছু ম্যানেজ করা আমাদের জন্যে খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল।"তাদের এরকম একটি ঘটনা আয়োজনের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। তাদের কাছে ছিল অল্প কিছু গাড়ি। কিন্তু তার জন্যে এসব চালাতে পেশাদার চালক ছিল না। মুক্তির পর নেলসন ম্যান্ডেলা যে গাড়িতে করে সেন্ট্রাল স্কয়ারের দিকে যাচ্ছিলেন সেটি জনতার ভিড়ে আটকা পড়ে গিয়েছিল। গাড়ির চালক সেসময় খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন।

এক পর্যায়ে নেলসন ম্যান্ডেলাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না।

"গাড়ির চালক নিরাপদে থাকতে চেয়েছিলেন এবং জনতার ভিড় থেকে নেলসন ম্যান্ডেলাকে বাঁচাতে তিনি তাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। আমরা তাকে ফোনও করতে পারছিলাম না।"

ভ্যালি মুসা বলেন, "আমরা কয়েকজন বুঝতেও পারছিলাম না যে কী করবো। আমাদের সঙ্গে আর্চ বিশপ টুটুও ছিলেন। এক পর্যায়ে আমরা নেলসন ম্যান্ডেলাকে হারিয়ে ফেললাম। আমরা জানতাম না তিনি কোথায়।"

কেপ টাউনের একজন ট্রাফিক অফিসার অবশেষে তাদেরকে জানালেন যে নেলসন ম্যান্ডেলাকে পাওয়া গেছে। তিনি জানালেন, স্থানীয় একজন রাজনৈতিক কর্মীর আত্মীয়দের সঙ্গে বসে তিনি চা খাচ্ছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলা টাউন হলের একটি ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেওয়ার জন্যে। সমবেত লোকজন তাকে দেখে উল্লাস করে উঠলো।

সমাবেশে যারা জড়ো হয়েছে তাদের অনেকেই এই প্রথম নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেখতে পেলেন। কারণ মি. ম্যান্ডেলা কারাগারে যাওয়ার পরেই তাদের জন্ম হয়েছে।জনতার উদ্দেশ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, "কোন মহান ব্যক্তি হিসেবে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছি আপনাদের একজন বিনীত সেবক হিসেবে।"

নেলসন ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন ১৯৬৪ সালে। এই অপরাধে তার সাজা হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। তার ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এমনকি তাকে উদ্ধৃত করে কিছু বলাও ছিলো বেআইনি।

কিন্তু এসব বিধিনিষেধ তার কারা-কক্ষকে প্রতিরোধের আন্তর্জাতিক প্রতীক হয়ে উঠতে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি।

১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের তুমুল আন্দোলন গড়ে ওঠে। সারা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করে সহিংসতা, ধর্মঘট, বয়কট ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।

১৯৯০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট এফ ডাব্লিউ ডি ক্লার্ক পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বর্ণবাদী শাসন অবসানের কথা ঘোষণা করলেন।

ভ্যালি মুসা বলেন, "আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এএনসি ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হলো। আমার মতো রাজনৈতিক নেতাদের ওপর থেকেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলো।"

কিন্তু সেদিনই ভ্যালি মুসা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে পার্লামেন্টের বাইরে বিশাল এক প্রতিবাদ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই আইন অমান্য করার ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটে যখন প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের ভেতরে ভাষণ দিচ্ছিলেন।

"এ ধরনের বিক্ষোভ ছিল খুবই বিরল ঘটনা। ওই সমাবেশের দাবি ছিল এএনসির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা এবং নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অন্যান্য রাজবন্দীদের মুক্তি। আমি যখন সমাবেশ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি তখন শাসকরা ঘোষণা করলো যে তারা এসব দাবি মেনে নিচ্ছে। ফলে আমি যে বেআইনি কাজ করছিলাম তখন হঠাৎ করেই সেটা আর বেআইনি থাকলো না।"সরকার তখনও ঘোষণা করেনি যে নেলসন ম্যান্ডেলাকে কখন মুক্তি দেওয়া হবে। শুধু বলা হয়েছে তাকে মুক্তি দেওয়ার কথা। মি. ম্যান্ডেলাকে স্বাগত জানানোর জন্যে যে কমিটি গঠন করা হয়েছিল তার একজন সদস্য ছিলেন ভ্যালি মুসা। এর আট দিন পর সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ফোন করে বৈঠকে ডাকা হলো এবং সেদিনই বলা হলো যে নেলসন ম্যান্ডেলাকে পরের দিন মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।

"বৈঠক খুব অল্প সময় স্থায়ী হয়েছিল। তারা জানালেন নেলসন ম্যান্ডেলা ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তাকে যেন জেলখানার গেটে মুক্তি দেওয়া হয়। যেন তুলে দেওয়া হয় তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের হাতে। তখন আমি ও আমার সহকর্মীদের মনে হয়েছিল যে তাদেরকে বলি, তোমরা কি তাকে আরো কিছু সময় জেলে আটকে রাখতে পারো না, যাতে আমরা কিছু একটা আয়োজন করতে পারি? কিন্তু আমরা সেরকম কিছু বলিনি।"

পরে তারা জানতে পেরেছিলেন যে নেলসন ম্যান্ডেলা তার মুক্তির ব্যাপারে আরো কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু ডাব্লিউ ডি ক্লার্ক সেই অনুরোধ রাখেন নি।

সরকার চেয়েছিল খুব নিরবে তাকে মুক্তি দিতে। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা তাতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি তাদেরকে জানান, অন্যান্য বন্দীদের যেভাবে মুক্তি দেওয়া হয় তিনিও ঠিক সেভাবেই জেল থেকে বের হয়ে যেতে চান।

মুক্তির আগেও নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে কয়েকবার দেখা করেছিলেন ভ্যালি মুসা। তিনি বলেন, "তার মুক্তির বিষয়ে উৎসব আয়োজন করার মতো কোন সময় আমাদের ছিলো না। এটাই ছিল বাস্তবতা। তিনিও খুব শান্ত ছিলেন। তার পর দিন কী হবে এসব বিষয়ে আমারা অনেক কিছু আলাপ করেছিলাম।"

কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলা চেয়েছিলেন, জেল থেকে বের হওয়ার পর জোহানেসবার্গে যাওয়ার আগে তিনি কেপটাউনে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। কারাগার থেকে তাকে সেন্ট্রাল স্কয়ারে নিয়ে যাওয়ার জন্যে স্থানীয় একজন রাজনৈতিক কর্মীর কাছ থেকে একটি গাড়ি ধার করতে হয়েছিল। লোকজনকে বলা হয়েছিল সেখানে জড়ো হতে।তখন তো ল্যাপটপ ছিলো না, তাই নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষণ টাইপ করতে ভ্যালি মুসাকে বেশ কয়েকবার কারাগার ও কেপটাউন শহরে যাওয়া আসা করতে হয়েছিল।

হাতে একেবারেই সময় ছিল না। ফলে নেলসন ম্যান্ডেলার স্ত্রী উইনি ম্যান্ডেলা, এএনসির আরো কয়েকজন নেতা তখন জোহানেসবার্গ থেকে একটি ভাড়া করা বিমান নিয়ে এসেছিলেন কেপটাউনে।

"এসব লোকজনের ভাড়া করা বিমানে চলাচলের কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। এছাড়াও একটা বোয়িং যতো সময় নেয়, ছোট্ট বিমানগুলো তার চাইতেও অনেক বেশি সময় নিয়ে থাকে। তারা প্রায় দ্বিগুণ সময় নিয়েছিল। তাদের আসতে দেরি হয়। ফলে দু থেকে তিন ঘণ্টা পর নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।"

এর কয়েক ঘণ্টা পর, যখন সন্ধ্যা নেমে আসে, নেলসন ম্যান্ডেলা কেপটাউনের টাউন হলের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভাষণ দিলেন জনতার উদ্দেশ্যে। তাড়াহুড়োর মধ্যে তিনি তার চশমা হারিয়ে ফেলেন।

"সিটি হলের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা জনতার সমুদ্রের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। মনে হচ্ছিল সবকিছু যেন নিখুঁতভাবে শেষ হচ্ছে। স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রামী বহু মানুষ তাদের জীবনে কখনো এধরনের চিত্র দেখতে পারে না। কিন্তু আমি সেই দৃশ্যটা দেখেছি। এবং এই মুহূর্তটি সারা জীবনই আমার সাথে থেকে গেছে।"

ভাষণে নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, "দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ, তারা আজ স্বীকার করে নিয়েছেন যে বর্ণবাদের কোন ভবিষ্যৎ নেই।"

নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট।

ভ্যালি মুসা পরে ম্যান্ডেলা সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সূত্রঃ বিবিসি বাংলা
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর