লিবিয়ার অস্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপ তথা বিভিন্ন দেশে লোক পাচারের অনৈতিক বাণিজ্যে জড়িত দেশিয় কারবারীদের পাকড়াও করার তাগিদ দিয়েছেন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ভেভেলপমেন্ট বিশেষজ্ঞ প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। এক যুগের বেশি সময় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এর হেড কোয়ার্টারসহ দুনিয়ার দেশে দেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এবং নীতি নির্ধারণী দায়িত্বপালকারী মিস্টার হক মনে করেন- যুদ্ধকবলিত লিবিয়ার মানবপাচারকারীদের চেয়ে বাংলাদেশে থাকা পাচারকারী চক্রটি ভয়ঙ্কর। তারা বাংলাদেশিদের প্রলুব্ধ করে এবং বিশাল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়। এরপর বিদেশিদের কাছে প্রায় বিক্রি করে দেয়। বিদেশী পাচারকারীরা তাদের জিম্মি করে বাড়তি অর্থ আদায়ে চাপ দিতে থাকে। মুক্তিপণের টাকা পেলে তাদের পাঠানোর ফন্দি করে, না হয় তাদের বর্বর নির্যাতন সইতে হয়। এ অবস্থায় কেউ মরে কেউবা ফিরে!
পেশাদার ওই কূটনীতিকের মতে, দেশীয় দালাল চক্র এবং তাদের প্রশ্রয়দানকারী সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে কেবল লিবিয়া বা ইতালির নয়, নিশ্চিতভাবে অন্য দেশেও মানব পাচার বন্ধ হবে। বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো সদ্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, লিবিয়ায় গত ২৮ মে পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার ২৬ বাংলাদেশির বিষয়ে যেসব রিপোর্ট বা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে এটা নিশ্চিত যে ভিকটিমদের বেশিরভাগই ইতালি বা ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভনে দালাল মারফত ঢাকা থেকে সেখানে গেছেন।
তারা কিভাবে বাংলাদেশ ছাড়তে পারলো? কে, কোথায় কিভাবে সহায়তা দিয়েছে? তা খতিয়ে দেখা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় পররাষ্ট্র সচিবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালনকারী শহীদুল হক ২০১৫ সালের (তার আমলের) একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। বলেন, ওই সময়ে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে লোক পাচারের অভিযোগের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তার লাগাম টানতে সরকার তথা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কিছু কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। কিন্তু কড়াকড়ি আরোপ সংক্রান্ত নিদের্শনা জারির পরপরই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। সেই সময়ে নির্দেশনা চ্যালেঞ্জকারী রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধিরা তাদের আইনজীবি মারফত যুক্তি দেখিয়েছিলের যে বিদেশে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের মঙ্গলের দায়িত্ব সরকারের নয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এটর্নি জেনারেলের অফিস তথা বাংলাদেশ সরকার ওই যুক্তির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল এবং পাল্টা যুক্তিতে তা খন্ডন করা হয়। ফলে আদালত চূড়ান্ত বিচারে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তকে বহাল রাখেন। প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব বলেন, যেহেতু লিবিয়ার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি, এখনও যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান। তাছাড়া সেই রায় এখনও তামাদি বা অকার্যকর হয়নি, বরং বলবৎ আছে। সুতরাং পাচারকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপে এ রায় রেফারেন্স হতে পারে।
কেবল বাংলাদেশ নয়, বৈশ্বিক ভাবেই একটি নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানবপাচার হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর সঙ্গে অনেকে অনেকভাবে জড়িত। তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। মানবপাচারের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার বৈশ্বিক অভিবাসন ব্যবস্থাকে একটি নতুন রূপ দেয়ার জন্য গ্লোবাল কমপ্যাক্টের প্রয়োজনীতাই কেবল অনুধাবন করেনি বরং এটি যে অপরিহার্য সেটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবেচনায় এনেছে। এ বিষয়ে জাতিসংঘে ঢাকার প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় বলেও স্মরণ করেন তিনি। মিস্টার হক বলেন, করোনাকালেও যেহেতু মানবপাচার সংশ্লিষ্ট লোকহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটছে তাই এটি রোধে দেশে দেশে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। জাতিসংঘে গৃহীত বাংলাদেশের প্রস্তাবটি এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সহায়ক হবে বলে মনে করেন বিশ্ব ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকারী ওই মাইগ্রেশন এক্সপার্ট। এ সময় বিশ্বব্যাপী মানবপাচার রোধে আইওএম এর ভুমিকার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, পাচার রোধে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম-এর জনসচেতনতামূলক পদক্ষেপসহ ঘটনা পরবর্তী অনেক কার্যক্রম রয়েছে। বিশেষ করে পাচারচক্রের জিম্মিদশা থেকে ছাড়া পাওয়া ব্যক্তি কিংবা হতাহতদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় সংস্থটির সহায়তামূলক কার্যক্রম অনন্য।