ভারতের সবচেয়ে ধনী শহর মুম্বই। কিন্তু খুব দ্রুততার সঙ্গে বিশ্বের পরবর্তী করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ বিপর্যয়ের স্থানে পরিণত হচ্ছে এই শহর। অনলাইন এবিসিতে প্রকাশিত এক রিপোর্টে এ বিষয়ে ভয়াবহ এক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ভারতে কোভিড-১৯ এ মোট যে পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন তার পাঁচ ভাগের এক ভাগেরও বেশি মুম্বইয়ে। রোগীতে উপচে পড়ছে শহরের হাসপাতালগুলো। মর্গে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই মৃতদেহ ওয়ার্ডেই বেডের ওপর রেখে দেয়া হয়েছে। তার পাশেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে আক্রান্তদের।
ওই রিপোর্টে সচিত্র এমন সব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন নারী উচ্চ মাত্রার জ¦রে আক্রান্ত হওয়ার পর পরীক্ষায় তার করোনা পজেটিভ এসেছে। কিন্তু হাসপাতাল তাকে জায়গা দিতে পারছিল না। কারণ, তাদের আইসিইউ পুরো ভর্তি। এমন অবস্থায় ওই তাকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য ফোনে চেষ্টা করতে থাকেন তার ছেলে। কিন্তু সব জায়গা থেকেই একই উত্তর পাচ্ছিলেন। কোন হাসপাতালেই খালি বেড নেই। এমন অবস্থায় তার ছেলে পারিখ বলেন, আমাদের বুক কেঁপে ওঠে। বুঝতে পারি না কি করবো। মার কি হবে তা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়ি। করোনা ভাইরাস মার ফুসফুসকে আক্রমণ করেছে।
এক পর্যায়ে ওইদিন রাতে তার মাকে আরেকটি হাসপাতালে স্থানান্তর করাতে সক্ষম হন পারিখ। কিন্তু বিপদ যখন আসে, তখন চারপাশ থেকে এক সাথে আসে। পরেরদিন সকালেই পারিখের ৯২ বছর বয়সী দাদার অক্সিজেন লেভেল একেবারে কমে যায়। বাসায় বসেই এই চেকআপ করা হয়। তিনি ডায়াবেটিসের রোগী। এ সময় পারিখের মধ্যে তার মায়ের পরিস্থিতির কথা মনে হয়। তিনি মনে করেন হয়তো একই পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে তার দাদাকে হাসপাতালে ভর্তি করার ক্ষেত্রে। অক্সিজেন সহ লাইফ সেভিং ব্যবস্থা আছে এমন একটি এম্বুলেন্স খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। অনেক চেষ্টার পর তিনি এর ব্যবস্থা করতে সক্ষম হন। কিন্তু এদিন সন্ধ্যায়ই হাসপাতালে মারা যান তার দাদা। তার পরীক্ষা করে দেখা যায়, তিনি করোনা পজেটিভ। পারিখ বলেন, রাগে ক্ষোভে বুকটা ফেটে যায়। কারণ, তাকে মৌলিক চিকিৎসাটা দেয়া হয় নি। কারণ, হাসপাতালে বেডের সঙ্কট ছিল।
ওদিকে পারিখের পিতা ও দাদী এখন হাসপাতালে। তাদেরও করোনা পজেটিভ। পারিখ হতাশা প্রকাশ করেন। বলেন, আমার ভয় হচ্ছে, হয়তো পুরো পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। মাত্র তিন থেকে চার দিনের মধ্যে আমার পরিবারের চারজনই করোনা পজেটিভ।
বিশ্বেরপরবর্তী বিপর্যয় মুম্বইয়ে?মুম্বইয়ে পারিখের পরিবারের মতো শত শত পরিবার আছে, যারা এই রকম ট্রাজেডির মুখোমুখি হয়েছেন বা হচ্ছেন। এই শহরে কমপক্ষে ৩৭ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১২০০। ভারতে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছেন তার মধ্যে এক চতুর্থাংশ এই মুম্বইয়ে। প্রতিদিন হাজার হাজার না হলেও কয়েক শত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি যে হচ্ছে না, তা স্পষ্ট। গত সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিও প্রকাশ হয়। তাতে দেখা যায়, করোনা রোগীরা ভর্তি আছেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন ওয়ার্ডে বিছানার ওপর পড়ে আছে সারিবদ্ধ মৃতদেহ। এসব মৃতদেহ কোথায় রাখা হবে তা নিয়ে হাসপাতালগুলোই শুধু হিমশিম খাচ্ছে এমন নয়। একই অবস্থা দাহ করার স্থানগুলো এবং মর্গেও। এতে স্বাস্থ্যখাতের কি অবস্থা তা পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে। চিকিৎসক ও নার্সদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে এ অবস্থায়।
মুম্বইয়ের একটি হাসপাতালের আইসিইউয়ের প্রধান শ্রুতি ট্যান্ডন বলেছেন, আমি যেসব হাসপাতালে কাজ করি, তাতে কোনো মর্চুয়ারি নেই। দু’জন মানুষ মারা গেছেন। কিন্তু পরের দিন সকাল না হওয়া পর্যন্ত সেই মৃতদেহ বেডের ওপরই পড়ে ছিল। কারণ, ওই মৃতদেহ দাহ করতে না নেয়া পর্যন্ত তা সরানো যাচ্ছিল না। সব দিক দিয়েই আমরা চাপে রয়েছি। এ এক ভয়াবহ অবস্থা।
আইসিইউ থেকে রোগী ফিরিয়ে দিচ্ছেন ডাক্তাররাভারতে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা কমপক্ষে এক লাখ ৮২ হাজার। রোববার সেখানে দৈনিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সংক্রমিত হয়েছেন। এ সংখ্যা ৮৩৮০। সবচেয়ে ভয়াবহ সংক্রমিতের মধ্যে মুম্বই অনেক দিন অবস্থান করছে। সেখানে উচ্চ মাত্রায় মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে। কেউ কেউ এটাকে নিউ ইয়র্কের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন মুম্বই হলে ‘ভারতের নিউইয়র্ক’। সরকারি হাসপাতালগুলোর বাইরে অসুস্থ রোগীর লম্বা লাইন। তারা তীব্র গরমে ভর্তি হওয়ার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করছেন।
ঘনশ্যাম যাদব নামে একজন এবিসি’কে বলেছেন, তিনি করোনা পজেটিভ এটা দেখানোর পরও তাকে ভর্তি করা হয় নি। নার্সরা বলেছেন, এক ঘন্টা পরে যেতে। তারপর বলেছেন, দু’ঘন্টা পরে যেতে। তারপর চার ঘন্টা পরে যেতে। এমন অপেক্ষা করতে করতে তিন দিন-রাত ধরে আমি রাস্তায় ঘুমাচ্ছি। কিছু মানুষের দেয়া খাবার ও পানি পান করে আমি বেঁচে আছি।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে শহরের সবচেয়ে বড় ও ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলোতে। সেখানে গণ গোসলখানা ও গণশৌচাগারে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা অসম্ভব ব্যাপার।
ডা. ট্যান্ডনের জন্য এই সঙ্কট শুরু হয় চার সপ্তাহ আগে। এ সময়ে তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে করোনা সংক্রমণ। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, তিনি করোনা রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ, কোনো ফাঁকা বেড নেই। পুরো একটা সপ্তাহ আমাকে কলের ওপর রাখা হয়েছে। ফলে আমি একটু ঘুমাতে পারি নি। এ সময়ে আমাকে বেড ম্যানেজ করতে হয়েছে। তারপরও রোগীদের না বলতে হয়েছে। এখন সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও তাকে তাড়া করে ফেরে, যেসব দৃশ্য তিনি হাসপাতালে দেখেছেন তা। ডা. ট্যান্ডনের ভাষায়, এই ভয়াবহতা আপনার সঙ্গেই থাকবে। এটা আপনাকে ভিতর থেকে হত্যা করতে থাকবে। বিশেষ করে যখন একজন রোগীকে আপনি ভর্তি করতে পারছেন না, তাকে ভর্তি করার ক্ষেত্রে বাধ্য হয়ে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, তখন তাকে পরোক্ষভাবে সরাসরি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। পরিস্থিতি এমনই অবনতি হচ্ছে। প্রতিটি শিফটে তিনি রোগীদের অক্সিজেন ট্যাংক থেকে ভেন্টিলেটর পর্যন্ত দেখাশোনা করেন। একবার এমনও চেষ্টা করেছেন যে, একটি ভেন্টিলেটরে কয়েকজন রোগীকে সংযুক্ত করা যায় কিনা।
সার্জন সঞ্জয় নাগরাল বলেন, মুম্বই হাসপাতালে পূর্ণ। কিন্তু এর বেশির ভাগই পুরোপুরি অপ্রস্তুত এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য। মেডিকেল ব্যবস্থার ওপর অতিরিক্ত চাপের ফলে এমন অনেক মৃত্যু ঘটছে যার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি আরো বলেন, প্রথম দু’চার সপ্তাহ খুবই বিপর্যয়কর। কারণ, বিপুল সংখ্যক রোগীর ডায়ালাইসিস করানো যায় নি। ডায়ালাইসিস সুবিধার সঙ্কটে মারা গেছেন অনেক মানুষ।
চিকিৎসকরাও নিরাপদ ননচিকিৎসকরা বলেছেন, করোনা ভাইরাসের বিস্তার শুরুর আগে থেকেই মুম্বইয়ের হাসপাতালগুলো তার সক্ষমতা অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু নার্স ও স্টাফদের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর কমপক্ষে চারটি হাসপাতালকে কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়েছে। মহারাষ্ট্রে কমপক্ষে ২১৫ জন ডাক্তার ও ৩১০ জন নার্স করোনা আক্রান্ত। তার মধ্যে মালবিকা নীরাজ অন্যতম। সেইন্ট জর্জেস হাসপাতালে করোনা পজেটিভ ধরা পড়েছে তার। মালবিকা বলেন, আমার বন্ধুরা বললেন, আমি হয়তো নার্স স্টাফ বা ইন্টার্নদের সংক্রমিত করছি। ঈশ^রই ভাল জানেন যে, আমি কোন রোগীকে সংক্রমিত করেছি কিনা। মালবিা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু হাসপাতালের কোয়ার্টারে তিনি কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। তার প্রতিবেশীরা চান না তিনি এখনই হাসপাতালে যোগ দিন। মালবিকা বলেন, এই অবস্থা সব ডাক্তারের। কারণ, তারা জানেন, এই ভাইরোস থেকে কেউই নিরাপদ নন।
এ অবস্থায় মহারাষ্ট্র বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে ব্যবহার শুরু করেছে। ডাক্তার ট্যান্ডন বলেন, এটা এক বৈশি^ক মহামারি। বিষয়টা দাঁড়িয়েছে জীবন এবং মৃত্যুর।