কোভিড-১৯ সারা বিশ্বকে বদলে দিলেও আমারা খুব একটা পরিবর্তিত হচ্ছি না। পারস্পরিক দোষরোপের রাজনীতি করতে করতে অন্যের ভুল ধরাই আমাদের মজ্জাগত স্বভাবে পরিণত হয়েছে। ইসলামপন্থীরাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। অথচ ইসলাম আমাদের কে বেশি বেশি আত্মপর্যালোচনা করার এবং ভিন্নমতের ব্যাপারে সহনশীল হওয়ার কথা বলেছে। বর্তমান এই কঠিন সময় আমি কি আমার দায়িত্ব পালন করছি? বিবেকের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই লেখা। কাউকে দোষারোপ করা বা খাটো করা- এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
প্রসঙ্গ কোভিড-১৯ হলেও এ লেখার প্রতিপাদ্য ভিন্ন এক উপলব্ধির। ভিন্নমাত্রার। পৃথিবীতে পরিবর্তনের উত্তাল ঢেউ বইতে শুরু করেছে।
আকাশে-বাতাসে পরিবর্তনের এক অনুপম আবহ। পরিবর্তনের এই অন্তর্নিহিত তাগিদকে অনুধাবন করা আমাদের জন্য অপরিহার্য। এটা প্রণিধানযোগ্য বিষয় যে, বৈশ্বিক নেতৃত্বে পালাবদল হতে চলেছে। এখন পরিবর্তন আত্মস্থ করতেই হবে।
আল্লাহ রব্বুল আলামীন যে সকল উদ্দেশে মানবজাতিকে ক্রাইসিসে ফেলেন তার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো নেতৃত্বের পরিবর্তন বা নতুন নেতৃত্ব তৈরি। বস্তুত ক্রাইসিসের সময়ই নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। আল্লাহ সুবহানুতায়ালা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার প্রেক্ষাপটে ইউসুফ আলাইহিসসালামকে কে নেতৃত্বে এনেছিলেন।
আমাদের নিকট ইতিহাসও তাই বলে। বৃটিশ না থাকলে ইকবাল, নজরুল পেতাম না। স্বাধীনতার প্রয়োজন না হলে বঙ্গবন্ধু পেতাম না। ১৫ই আগস্ট না হলে জিয়া রাস্ট্রনায়ক হতেন না। ক্রাইসিস না হলে খালেদা জিয়া কিংবা শেখ হাসিনা ইতিহাসের অংশ হওয়ার সুযোগ পেতেন না। এরূপ উদাহরণ বিস্তর।
আবার এটাও বাস্তব যে, শুন্যতা কারো জন্য অপেক্ষা করবে না। আমি না পারলে কেউ না কেউ দ্রুত সে শুন্যতা পূরণ করবে। এখানে প্রচ্ছন্ন ও উম্মুক্ত উভয় প্রতিযোগিতাই বিদ্যমান। আমি রেডি না হওয়ার অর্থ আমি আল্লাহর অনুগ্রহ গ্রহণে পশ্চাৎপদ।
বর্তমান পরিস্থিতিতেও বৈশ্বিক নেতৃত্বে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কুরআন, সুন্নাহ ও ইতিহাস সাক্ষী, সংকটময় মুহুর্তে যারা সাহসী ভূমিকা পালন করে তাদেরকেই আল্লাহ দুনিয়ায় সম্মানিত করেন এবং নেতৃত্ব প্রদান করেন। গাজী সালাইদ্দীনের ইতিহাস সেটাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আর যাদের যথাযথ ইখলাস থাকবে তাদের জন্য আখেরাতের পুরস্কারের নিশ্চয়তাও আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণায় বিধৃত।
ইতিমধ্যে কোভিড-১৯ নৈরাজ্যকালের তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা দীনপন্থীরা সময়ের দাবি পূরণে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারিনি। বিভেদ আর বাগাড়ম্বরপূর্ণ বচনযুদ্ধে মগ্ন থেকেছি। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক দেশি-বিদেশি সেক্যুলার প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নির্দেশনায় সেইফ জোনে ওঠাবসা করাই প্রজ্ঞার পরিচয় গণ্য করলাম। সামাজিক দুরত্ব হবে, না শারিরীক দুরত্ব- সেটাই বুঝতে পারলাম না।
শুরুতেই কিছু বিজ্ঞ, জনপ্রিয় বক্তা ও নেতা করোনাকে আল্লাহর সৈনিক আখ্যা দিয়ে দিলেন, আর আমরা অনেকেই মনে করলাম হতেও পারে। অপরদিকে বেশিরভাগ স্কলার ও ইসলামপন্থী দল এ সময়েও দীনের প্রচার, প্রসার ও প্রশিক্ষণকেই বেশি গুরুত্ব দিলেন। পরিস্থিতির ব্যাপকতা, বহুমুখিতা ও গভীরতা আঁচ করা সম্ভব হয়নি। একে একে ইবাদত ব্যবস্থাপনা মুখ থুবড়ে পড়তে থাকল। হজ্জ, উমরা, তারাবীহ, খতমে কুরআন, মিম্বরের খুতবা, ইতেকাফ, সলাতুল জুমআ, সলাতুল ঈদ, নিয়মিত সলাত, মসজিদ ব্যবস্থাপনা, যাকাত ব্যবস্থাপনা, মাদ্রাসার ইলম চর্চা, ওয়াজ মাহফিল, তাবলীগের দাওয়াত ও তালীম, পীর সাহেবের ওরশ ও সবক, সবকিছু সংকুচিত হয়ে পড়ল। তা সত্বেও আল্লাহর ক্রোধের কারণ অনুধাবন অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করতে পারলাম না। প্রায় সবাই ফেসবুক বা ইন্টারনেট মুফতি হয়ে গেলাম। ভুলেই গেলাম আল্লাহর নির্দেশ :
‘অতএব যখনই তুমি অবসর পাবে, তখনই কঠোর ইবাদতে রত হও। আর তোমার রবের প্রতি আকৃষ্ট হও।’ সুরা-ইনশিরাহ-৭-৮
নিকৃষ্ট স্থান বাজারে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য শোনা গেল না অথচ ইবাদতের জায়গা থেকে জীবাণু সংক্রমণের আশঙ্কা নিয়ে ফেসবুক, ইউটিউবে লেখা, কথা, আর কার্টুনের স্তুপ জমে গেল। আমরা আমতা আমতা করে সময় পার করলাম।
একদিকে অভ্যন্তরীণ সমস্যা এবং অন্যদিকে ইসলাম বিরোধীদের কদর্য আক্রমণ। এহেন কঠিন সময়েও আমরা সমন্বিত উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছি। মহাসংকট পরিস্থিতিতেও আলেম সমাজ ও ইসলামী নেতৃবৃন্দ একত্রে বসতে পারেনি। কোনো ব্যাপারে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। যে কারণে দেশে লক্ষ লক্ষ আলেম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, ইসলামীপন্থী ছাত্র ও যুবক থাকার পরও সীমিত ত্রাণ-সামগ্রী বিতরণ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ দৃশ্যমান হয়নি।
সর্বোত্তম কাজ কোনটি এ ব্যাপারে রাসূল (স.) থেকে বেশ কয়েকটি বর্ণনা এসেছে-
বলা হয়েছে, ‘ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ হলো সালাত আদায় করা।’ আবার বলা হয়েছে, ‘ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ হলো, ‘মকবুল হাজ্জ’, অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ পিতা-মাতার সেবা করা।’ অন্য হাদীসে এসেছে, ‘ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ্।’ আবার বলা হয়েছে, ‘ঈমান আনার পর সর্বোত্তম কাজ মানুষকে খাবার খাওয়ানো।’
এ ব্যাপারে ইবনে কাইউম (র) বলেছেন, পরিস্থিতির আলোকে নির্ধারিত হয় কোন কাজ সর্বোত্তম। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ঈমানের পর সলাত, সামর্থ থাকলে হজ্জ, পিতা-মাতা অসুস্থ থাকলে পিতা-মাতার সেবা, দেশ আক্রান্ত হলে জিহাদ আর দেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলে তখন মানুষকে খাবার খাওয়ানো সর্বোত্তম কাজ।
এ রকম সুস্পস্ট নির্দেশনা থাকার পরও আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাজের অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারিনি। ব্যাপক প্রচার ও কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা, আক্রান্ত ব্যক্তি ও পরিবারের পাশে দাঁড়ানো এবং দাফন-কাফনে সহযোগিতাকে যদি অগ্রাধিকার দেয়া হতো, সরকারও যদি তাদের কাজে লাগাতো তাহলে বাংলাদেশে আজ যে মানবিক বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে তা দেখতে হতো না। যদি কোনো গ্রামে ইমাম, মাদ্রাসাছাত্র বা ইসলামীপন্থী যুবকরা আক্রান্ত পরিবার বা মৃতদের দাফন-কাফনের পক্ষে দাঁড়াতো তাহলে লাশ দাফনে বাধা দেয়া, আক্রান্তকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া, মাকে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, স্বামীকে ঘরে ঢুকতে না দেয়ার মতো ঘটনা এতো প্রকট হতো না। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাড়িয়েছে যে, ঘনিষ্ঠ লোকজন আক্রান্ত হওয়ার পর বা মারা যাওয়ার পর দীনদার লোকেরাও পাশে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে না।
যদি নেতৃপর্যায় থেকে আলেম সমাজ, মাদ্রাসার ছাত্র, ইসলামীপন্থী ছাত্র-যুবকদের জন্য স্ট্রং মোটিভেশন থাকতো তাহলে যে লোকেরা শাপলা চত্বরে জীবন দিয়েছে, গুলির সামনে মিছিল করেছে, তারা অবশ্যই সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রাখতে পারতো। দীনপন্থীরা সাহসের সঙ্গে ভূমিকা রাখলে ডাক্তারসহ সর্বস্তরের মানুষ সাহস পেতো। সবার মধ্যে যে পলায়নপরতা তা হয়তো হতো না।
আজ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, নারায়ণগঞ্জের খোরশেদ আলমের মতো ব্যক্তিদের অসুস্থতার খবরে মানুষ জায়নামাজে বসে দু’আ করে। এহসান ফাউন্ডেশনের কর্মীদের দাফনসেবায় সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত। মারকাজুলের সেবায় জনগণ মুগ্ধ। কিন্তু যারা আমরা সর্বস্তরে ইসলামী নেতৃত্ব কায়েমের মাধ্যমে কল্যাণ সমাজ বিনির্মাণের মিশনে আত্মনিয়োজিত তাদের বলিষ্ঠ উপস্থিতি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিসীমার গোচরে নেই।
সবচেয়ে বড় কথা আমি নিজে যদি আক্রান্ত হই বা মারা যাই, তাহলে কি আশা করি না আমার ঘনিষ্ঠজনেরা পাশে থাক! আমি যদি অন্যের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে আমি কি করে আশা করবো যে, অন্যরা আমার পাশে দাঁড়াবে। আবার আমার পিতা-মাতা, স্ত্রী-সন্তান অথবা ঘনিষ্ঠজন কেউ যদি আক্রান্ত হয় তাহলে আমি কি করব? তাদের ছেড়ে চলে যাব? আসুন আমরা এভাবে পরিস্থিতিকে কল্পনা করি, তাহলে আমাদের নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করা অনেক সহজ হবে।
সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের প্রো-এ্যাকটিভ ভূমিকা সংহত করা অপরিহার্য। আমাদের আরও পজিটিভ রোল রাখতে হবে। হতে হবে ইনোভেটিভ, ক্রিয়েটিভ এবং এ্যাসারটিভ। লাগবে ডেডিকেশন এবং কমিটমেন্ট। নেতৃবৃন্দ এবং ইনটেলেকচুয়ালদের এগিয়ে আসতে হবে। উপরের নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে সকলকে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। কুরআন সুন্নাহর নির্দেশনাবলীকে পরিস্থিতির সঙ্গে কাস্টমাইজ করতে হবে। এজন্যে বিভিন্ন ডিসিপ্লিনের অভিজ্ঞদের সঙ্গে সাথে সতে হবে। ইনফরমেশন ও নলেজের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শি চিন্তার অনুশীলন করতে হবে। এখানটায় তাকওয়া বা পদ-পদবি কম থাকলেও দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইসলামের ইতিহাসে এর অনেক দৃষ্টান্ত আছে। সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের কথাই বিবেচনা করা যেতে পারে। এখনই সময় ভূমিকা রাখার।
যথাযথ ভূমিকা রাখতে যে বিষয়গুলো অপরিহার্য
১. করোনা সম্পর্কে ধর্মীয় ও বিজ্ঞানসম্মত অধিকতর স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করা।
২. করোনা সংক্রমণ থেকে সুরক্ষার জন্য যে সকল সতর্কতা অবলম্বন করতে হয় তা যথাযথভাবে জানা।
৩. পরিচিত জন, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশি, সহকর্মী প্রয়োজনে সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুসহ সকলকে আশ্বস্ত করা যে, তাদের যে কোনো বিপদে কেউ না থাকলেও আমি আছি।
৪. চিকিৎসা সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারণা অর্জন করা।
৫. সহযোগিতা করার জন্য যে সকল প্রস্তুতি দরকার তা থাকা। আমরা অবশ্যই সকলে সব কাজ করব না, তার দরকারও নেই । তবে কোন কাজ কাকে দিয়ে কিভাবে কোথা থেকে করাতে হবে সে ব্যাপারে যথাযথ ধারণা থাকা।
৬. যদি পরিস্থিতি এমন হয় সহযোগিতা করার জন্য কেউ নেই, তাহলে আমি একাই মাঠে থাকব- এমন দৃঢ় মানসিক শক্তি অর্জন করা।
মনে রাখতে হবে দান ও রোগী সেবার ফজিলত আর দাফন সেবার মর্যাদা বর্ণনা করে বেশি লাভ হবে না, যদি নিজেরা সাহসের সঙ্গে দৃষ্টান্ত স্থাপনযোগ্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে না পারি। শহীদ ডা. মঈন পথ দেখিয়ে গেছেন। আল্লাহ আমাদের সক্ষমতা দান করুন।
লেখক: উদ্যোক্তা ও সমাজকর্মী