মহামারি করোনাকালে দুর্ভোগে রয়েছেন গৃহপরিচারিকারা। অনেকেরই কাজ নেই। খেয়ে না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন তারা। চাকরি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে সংকটে রয়েছেন গৃহকর্ত্রীরাও। গৃহপরিচারিকা রাখতে না পেরে অনেকেই বাসার পুরো কাজ নিজেরা করছেন। রাজধানীর ফকিরাপুলে নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছেন চার নারী। এরমধ্যে তিনজনই কাজে নতুন।
কাজের গতি কম হওয়ায় বারবার তাড়া দেয়া হচ্ছিল তাদের। কথা বলে জানা গেছে, মধ্যবয়সী এই তিনজনের নাম মনিরা, রেহেনা ও লতিফা। কিছুদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছেন তারা। মনিরা কাজ করতেন নিকেতনে তিনটি বাসায়। থাকতেন তেজগাঁও এলাকায়। মার্চের ১৫ তারিখের পরই বাসার গৃহকর্ত্রীরা কাজে যেতে নিষেধ করে দেন। লকডাউনে স্বামী, সন্তান নিয়ে বাসায় ছিলেন। স্বামী রিকশা চালক। তার তেমন রুজি নেই। মূল রাস্তায় দীর্ঘদিন রিকশা বন্ধ ছিল। এতদিন মূলত গৃহকর্ত্রীরাই সহযোগিতা করেছেন। তাদের দেয়া আর্থিক সহযোগিতায় চলেছেন। কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না কোথাও। করোনাভাইরাসের কারণে বাইরের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে বাসায় কাজ করতে দিচ্ছেন না গৃহকর্ত্রীরা। এটি এক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হওয়ার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন মনিরার মতো রাজধানী ঢাকার গৃহকর্মীরা। একই ঘটনা ঘটেছে রেহেনা ও লতিফার ক্ষেত্রেও। ধানমণ্ডিতে বিভিন্ন বাসায় কাজ করতেন তারা। কাজ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তারা। রণি মোল্লা নামে এক শ্রমিক জানান, এই কাজে অভিজ্ঞতা না থাকায় কষ্ট হচ্ছে তাদের। নির্মাণ কাজ, অনেক পরিশ্রমের। নির্মাণ কাজ করে প্রতিদিন সাড়ে ৩শ’ টাকা করে পাচ্ছেন এই নারীরা।
বাসাবো থেকে হেঁটে প্রতিদিন রামপুরায় রাস্তা সংস্কারের কাজে যোগ দেন রহিমা বেগম। পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী এই নারী জানান, আগে তিনি মেসে রান্না করতেন। ছাত্রদের মেস। লকডাউনের কয়েক দিন আগেই একে একে সবাই মেস ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে ছাত্ররা। তারপর থেকেই বেকার তিনি। এরমধ্যে বাসা বাড়িতে চাকরি খুঁজছেন। ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে বলে কেউ কাজে নেয় না। রহিমা জানান, বাসা অনেক দূরে। রিকশায় আসা-যাওয়া করলে ভাড়া দিতেই সারাদিনের রুজির অর্ধেক টাকা চলে যাবে। তাই হেঁটেই রামপুরায় পৌঁছে কাজে যোগ দেন। দুপুরে চিড়া আর গুড় খান তিনি। কখনো পান্তাভাত।
খিলগাঁও মডেল স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন এলাকায় বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন সুমি। থাকেন একটি ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে। এক আত্মীয়ের সঙ্গে। করোনা সংক্রমণের শুরুতে দুর্ভোগে পড়েন তিনি। একে একে প্রতিটি বাসা থেকে কাজে যেতে মানা করা হয়। চোখে অন্ধকার দেখতে পান সুমি। তিনি জানান, খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছে। যেসব বাসায় কাজ করতেন তাদের বাসায় গেলেও গেট থেকে বিদায় করে দেয়া হয়। তবে এরমধ্যে কেউ কেউ চাল, ডাল ও নগদ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। সুমি জানান, শেষ পর্যন্ত একটি বাসায় কাজ করছিলেন তিনি। কিন্তু ওই ভবনের বাসিন্দারা বাইরের লোক ঢুকতে কড়াকড়ি করলে সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জনের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়েই চলছেন তিনি। মহাখালীর বাসিন্দা মৌসুমি জানান, কোনোদিন কারও বাসায় কাজ করবেন তা চিন্তা করেননি। স্বামী মারা যাওয়ার পর গৃহপরিচারিকার কাজ শুরু করেন তিনি। দুই সন্তানকে নিয়ে ভালোই চলছিল তার। করোনা সংক্রমণের কারণে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। নিজের জমানো টাকা ও একটি স্বর্ণের চেইন বিক্রি করে চলেছেন এতদিন। এখন কষ্টে দিনাতিপাত করছেন এই নারী।
এদিকে, গৃহকর্মীদের দিয়ে কাজ না করাতে পেরে কষ্টে রয়েছেন গৃহকর্ত্রীরা। মোহাম্মদপুর এলাকার এক শিক্ষিকা জানান, লকডাউনের শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে রয়েছেন তিনি। নিজের ও সন্তানদের স্কুল বন্ধ থাকায় বাইরে রয়েছেন। ঢাকায় ফেরার ইচ্ছে হলেও ফিরছেন না। ঢাকায় ফিরে পুরো বাসার কাজ তাকে করতে হবে। আবার করোনার কারণে বাইরের কাউকে কাজে নেয়ার ঝুঁকি নিতে চান না তিনি। একইভাবে মিলি নামে একজন আইনজীবী জানান, মার্চের ২০ তারিখেই গৃহকর্ত্রীকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করেছেন। কোর্ট বন্ধ। বাসায় রয়েছেন তিনি। বাসার কাজ নিজেই করছেন। কাজ করতে গিয়ে পেশাগত বিভিন্ন কাজ যা বাসায় থেকে করা সম্ভব তা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না জানান তিনি। এমনকি অবসর কাটানোর ফুরসৎও খুব কম পাচ্ছেন।