× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১১ মে ২০২৪, শনিবার , ২৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিঃ

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন / হাগিয়া সোফিয়া: ধর্মীয় রাজনীতির খেলায় মেতেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট

বিশ্বজমিন

মানবজমিন ডেস্ক
(৩ বছর আগে) জুলাই ১৪, ২০২০, মঙ্গলবার, ৮:২৮ পূর্বাহ্ন

হাগিয়া সোফিয়ার জন্ম হয়েছিল গির্জা হিসেবে, বাইজেনটাইন বিশ্বের অন্যতম এক আইকন হিসেবে। পরবর্তীতে অটোম্যান তুর্কিরা সে গির্জাকে মসজিদে রূপান্তর করে। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাবের উত্তরসূরিরা এসে সে মসজিদকে বানায় জাদুঘর। এখন তা ফের রূপান্তর করা হবে।

শ্রমিকেরা নরম কাঠের একটি মিম্বর ঠেলে গির্জাটির মাঝখানে নিয়ে গেছে। আরেকটি মিহরাব নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিকটবর্তী একটি চত্বরে। ১৩ শতকের খ্রিষ্টীয় চিত্রাঙ্কন অস্পষ্ট করে ফেলতে দেয়ালে আঁকা হয়েছে নতুন চিত্র। মার্বেল পাথরের মেঝেতে বিছানো হয়েছে লাল কার্পেট। একজন মুয়াজ্জিন মুসল্লিদের নামাজ আদায়ে ডাক দিতে আজান দিলেন।
হাগিয়া সোফিয়া গির্জা থেকে বদলে মসজিদ হয়ে গেল।

উপরে বর্ণিত ঘটনাটি ২০১৩ সালের। এ ঘটনা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি পর্যটকের কাছে হাগিয়া সোফিয়ার শহর নামে পরিচিত ইস্তাম্বুলের নয়, ট্রাবজনের। ট্রাবজনে একসময় গ্রিকদের বসবাস ছিল। সেখানেও একটি হাগিয়া সোফিয়া রয়েছে, তবে সেটি আকারে মূল হাগিয়া সোফিয়ার চেয়ে ছোট। আদতে তুরস্কজুড়ে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের আমলে নির্মিত অন্তত পাঁচটি হাগিয়া সোফিয়া (পবিত্র জ্ঞান) নামের প্রাক্তন গির্জা রয়েছে। গত দশকে এর মধ্যে অন্তত চারটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখন সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভবনটির ভাগ্যও একই দিকে ধাবিত হতে যাচ্ছে।

১০ই জুলাই একটি ইসলামিক এনজিও’র আবেদন মেনে তুরস্কের শীর্ষ প্রশাসকরা ১৯৩৪ সালে হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘর করার রায় বাতিল ঘোষণা করলেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়্যিপ এরদোগান, এরপর একটি ডিক্রি জারি করে জাদুঘরটির মসজিদে রূপান্তর করার নির্দেশ দিলেন। তিনি এমনটা করবেন সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। গত বছরই তিনি বলেছিলেন যে, ভবনটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা একটি অনেক বড় ভুল। গত মাসে তিনি জানান, ১৫ই জুলাই ভবনটির ভেতর নামাজ আদায় করা হবে। এদিন তার বিরুদ্ধে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চতুর্থ বার্ষিকী পূর্ণ হবে।

হাগিয়া সোফিয়ার নির্মাতা ছিলেন বাইজেনটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান প্রথম। একটি গির্জার স্থলে এটি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছিলেন তৎকালীন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের প্রতিষ্ঠাতা কনস্টানটিন নিজে। ৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের ঐতিহাসিক রাজধানীতে ছায়া ফেলে আসছে হাগিয়া সোফিয়া। শুরুর দিকের পর্যটকরা এর মোহনীয় সৌন্দর্য্যে ভাষা হারিয়ে ফেলতেন। বিশেষ করে, লাখো সোনার টাইল্‌স দিয়ে তৈরি ভবনটির কেন্দ্রীয় মিনার ছিল সকলের নজরকাড়া। দশম শতকে সেখানে নিযুক্ত রোমান দূত কিয়েভাব রুস এক প্রতিবেদনে এর সৌন্দর্য্যের বর্ণনায় লিখেছিলেন, আমরা বুঝিনি আমরা কোথায় আছি, বেহেশতে না পৃথিবীতে। ১২০৪ সালে ক্রুসেডররা গীর্জাটিতে ভাঙচুর চালায়। লুট করে নিয়ে যায় এর সোনা, রুপা ও অন্যান্য অলঙ্কার। সেসব লুট হওয়া অলঙ্কারের স্থান হয় ভেনিসে। একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৪৫৩ সালে। অটোমানরা পুরো শহর দখল করে নেয়। তাদের ভাষ্যমতে এটি ছিল, ‘বিশ্বের শেষপ্রান্তে অবস্থিত লাল আপেল’। ২১ বছর বয়সী সুলতান মেহমেত ধুলো উড়িয়ে এগিয়ে যান অত্যাশ্চর্যকর হাগিয়া সোফিয়ার দিকে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরের নির্দেশ দেন। প্রায় পাঁচ শতাব্দী পর আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা কামাল আতার্তুক এটিকে রূপ দেন জাদুঘরে।

এরদোগান থাকেন এক হাজার ১০০ কক্ষের প্রাসাদে। তার চারপাশের থাকে তার অনুগ্রাহীরা। সরকারের উচ্চপদে নিয়োগ দেন পরিবারের সদস্যদের। কিন্তু নিজেকে কোনো সুলতানের সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করেন না। যদিও তিনি ইস্তাম্বুল ও হাগিয়া সোফিয়াকে ফের জয় করতে চান।

বহু বছরের মাঝে দ্বিতীয়বারের মতো মন্দার মুখে রয়েছে তুরস্কের অর্থনীতি। দেশের আর্থিক অবস্থা থেকে নজর সরাতে চান তিনি। আগামী নির্বাচনে তার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (একে) পার্টির পক্ষে সমর্থন জোগাড় করতে চান। কাদির হাস ইউনিভার্সিটির সলি ওজেল বলেন, আমরা হাওয়ায় চলমান সরকারের সঙ্গে বাস করছি। বর্তমানে তাদের ঝুলিতে আছে কেবল ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের প্রলোভন। জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ তুর্কিই হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর সমর্থন করবেন। কিন্তু অনেকে এটাও বিশ্বাস করেন যে, সরকার এই ইস্যু ব্যবহার করে জনগণের দৃষ্টি আরো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে। কেউ কেউ সন্দেহ করেন, এরদোগান হয়তো আগাম নির্বাচনের পরিকল্পনাও করছেন। যদিও মাত্র দুই বছর আগেই নির্বাচন হয়েছে। এ সবকিছুই, লম্বা সময় বিরতির পর করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির মধ্যে তুরস্কে নতুন করে দমন-পীড়ন শুরু হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে।

গত মাসে তিনজন বিরোধীদলীয় এমপি ও দু’জন সাংবাদিককে গুপ্তচরবৃত্তি ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে; অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দু’জনসহ মোট চারজন মানবাধিকারকর্মীকে চার থেকে ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে; বিরোধীদলপন্থি একটি টিভি চ্যানেল এবং সাবেক এক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। লকডাউন শেষ হয়েছে। তার জায়গায় দমন শুরু হয়েছে। এরদোগানের নিজের লিগ্যাসি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারও আছে। আঙ্কারাভিত্তিক থিংকট্যাংক তেপাভের সেলিম কোরু বলেন, এরদোগানের সরকার ও এর ধর্মীয় সমর্থনকারীরা গত শতকের বিশের দশকে আতার্তুকের শুরু করা যুগকে তুরস্কের ইতিহাসে একটি ‘প্রথম বন্ধনী’ হিসেবে দেখে। হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করা হলে সে বন্ধনী পূর্ণ হবে। অপর এক থিংকট্যাংক ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউটের সোনার কাগাপ্তে বলেন, আতার্তুক তার ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা করতে হাগিয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপ দিয়েছিলেন, ধর্মকে সর্বসাধারণের অংশ থেকে উঠিয়ে নিয়েছিলেন। এরদোগান ঠিক তার উল্টোটা করছেন। বিশ্বে উন্মুক্ত মুসলিম সমাজ হিসেবে তুরস্কের যে খ্যাতি রয়েছে, এরদোগানের পদক্ষেপ সে খ্যাতি ক্ষুণ্ন করছে। মিত্রদের সঙ্গেও দেশটির সম্পর্কে ফাটল দেখা দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ইতিমধ্যেই এরদোগানকে হাগিয়া সোফিয়ার রূপান্তর বন্ধ করতে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। বলেছেন, এতে বিশ্বজুড়ে লাখো খ্রিস্টান ইসলামবিরোধী হয়ে উঠবে। রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এই রূপান্তর মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা দিবে। হয়তো এরদোগানের মূল পরিকল্পনা তেমনই। আজকাল বিদেশি শক্তিদের সঙ্গে সংঘাত তুরস্কে বেশ ভালোই গৃহীত হয়। তবে এতে যে ক্ষতি হবে তা হয়তো আর কখনোই পূরণ হবে না।
(দ্য ইকোনমিস্টে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনের অনুবাদ।)
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর