× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার , ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

করোনায় আলোচনায় যারা

এক্সক্লুসিভ

পিয়াস সরকার
২১ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার

হঠাৎ ঝড়। ঝড়টার নাম নোভেল করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯। গোটা বিশ্বের মতো থমকে দিয়েছে বাংলাদেশকেও। প্রাণ কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি আয়হীন করেছে লাখো মানুষকে। কিন্তু মহামারি অবস্থাতেও অনেকেই গড়ে নিয়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ। জয় করেছেন মানুষের ভালোবাসা।

রাজধানী ঢাকার পরে করোনার প্রকোপ অধিক এলাকার মধ্যে অন্যতম নারায়ণগঞ্জ। এই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের আলোচিত কাউন্সিলর মাকছুদুল আলম খন্দকার খোরশেদ। তিনি এখন পর্যন্ত ১০৫টি লাশ দাফন ও সৎকার করেছেন।
এ ছাড়াও এই সময়ে ত্রাণ বিতরণ থেকে শুরু করে প্লাজমা ব্যাংক গড়ে তুলেছেন।

খোরশেদ বলেন, করোনা আসার পর দেখি স্বজনের লাশ দাফন করতে ভয় পাচ্ছে। ৩০শে মার্চ জেলা প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও মেয়রের কাছে আবেদন করি, লাশ দাফন-সৎকারের দায়িত্ব নিতে চাই। পরবর্তীতে লিখিত কোনো জবাব না পেলেও ৮ই এপ্রিল প্রথম একটা মেয়ে ফোন করে আপনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন আপনি দাফন কাফন করবেন। কোনো আত্মীয় প্রতিবেশী এগিয়ে আসছেন না। আমার কোনো ভাই নাই- দুই বোন। পরে আমরা প্রথম ৮ই এপ্রিল এটা শুরু করি। এমন অবস্থা হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মুখাগ্নী করতেও।

খোরশেদ আরো বলেন, ৮টি লাশ ছিল যাদের পরিবারের লোকজন খোঁজ পর্যন্ত নেননি যে তাদের স্বজনের লাশ দাফন করেছি না ফেলে দিয়েছি। এরমধ্যে একজনের লাশের খোঁজ নিয়েছেন পরিবারের লোকজন। আর বাকিদের লাশ আমরা প্রায় ৩ মাস ধরে পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। মর্মস্পর্শী কোনো ঘটনা জানতে চাইলে বলেন, একবার আমরা গিয়ে দেখি সিঁড়ির মধ্যে লাশ পড়ে রয়েছে। খোকন সাহা নামে এক হিন্দু ভদ্রলোক। তার জন্য এম্বুলেন্সও আনেন স্ত্রী। তাকে ধরে ৪ তলা থেকে নিচে নামাবো এরকমও কোনো প্রতিবেশী এগিয়ে আসেন নি। তার মা ও স্ত্রী কাঁধে ভর করে নামানোর চেষ্টা করছিলেন। ৩ তলা আর ৪ তলার সিঁড়ির মাঝখানে এসে উনি পড়ে যান। পানি খেতে চেয়েছিলেন। পাশের ফ্ল্যাটের লোকরা দরজা খুলে পানি দেন নাই। তার মা ৪ তলা থেকে পানি এনে দিয়েছেন। সেই পানি খেয়ে মারা যান তিনি। তার মা, স্ত্রী, মেয়ে সিঁড়িতে বসে লাশের পাশে কান্নাকাটি করছিলেন। পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা তুলে দিয়ে বলেন, লাশ এখানে পড়ে থাকবে- তোমরা যাও। তোমাদের রোগী করোনায় মারা গেছে। সেদিন ছিল দ্বিতীয় রোজার দিন। স্ত্রী বলেন, কেউ এগিয়ে আসে নি। তিনি অনুরোধ করে বলেন, তার ছেলে নাই। আপনারাই মুখাগ্নী করেন।

একবার এক সন্তানের লাশ নিয়ে যাচ্ছিলাম। তার বাবা প্রায় ৮০ বছর বয়স। তিনি বলেন, বাবা আমি খাটিয়ার এক মাথা ধরতে চাই। বলি, এতো অনেক ওজন, আপনি পারবেন না। তিনি বলেন, বাবা হয়ে ছেলের মৃত্যু সহ্য করতে পারছি। এই ওজনটাও সহ্য করতে পারবো। আরেকটি ঘটনা তিনি বলেন, আমরা দরজায় নক করছি। দূর থেকে তার স্ত্রী ও মেয়ে দেখিয়ে দেয় লাশ। বলেন, ঐ রুমে আছে নিয়া যান। মানে একটা বস্তুর মতো।

আলোচিত কাউন্সিলর খোরশেদ নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়, স্ত্রীসহ। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীর শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফুস ৫৪ শতাংশ অক্সিজেন নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন একটা অক্সিজেনের জন্য অনেক জায়গায় দৌড়াইছি। হাসপাতালে নেয়ার আগ পর্যন্ত অক্সিজেন পাওয়া যায় নি। এখন আমরা হাসপাতাল থেকে আসার পরে অক্সিজেন সংগ্রহ করি। সেইসঙ্গে আমরা প্লাজমা ব্যাংক তৈরি করেছি।

এদিকে টানা ১১৯ দিন যাবৎ রাজধানীর ভাসমান মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করে আসছেন সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নেতা তানভীর হাসান সৈকত। করোনার প্রভাবে আয় হারানো মানুষদের টানা ১শ’ দিন দু’বেলা করে খাইয়েছেন তিনি। প্রতিবেলা প্রায় ৫শ’ লোকের খাবারের ব্যবস্থা করছেন তিনি। এরপর ১৮ দিন যাবৎ দিচ্ছেন একবেলা খাবার।

তিনি বলেন, খাবার বিতরণের সময় খুবই শৃঙ্খলা মেনে চলেন তারা। সামাজিক দূরত্ব মেনেই লাইনে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করছেন খাবার। অধিকাংশ দিন দেখা যায় আমি আসার আগেই খাবারের জন্য দূরত্ব বজায় রেখে তারা দাঁড়িয়ে পড়েন।

সৈকত খাবার দেয়ার পাশাপাশি অসহায়দের মাঝে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ, ঈদ উপহার বিতরণ করেন। তিনি আরো বলেন, এই খাবার দেয়ার কার্যক্রম আর বেশিদিন পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আমি তাদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করণের জন্য কাজ করতে চাই।

খোরশেদ কিংবা সৈকতের মতো অনেকেই এগিয়ে এসেছেন ব্যক্তি উদ্যোগে। আবার অনেকে সংগঠনের ব্যানারে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ক্ষতিগ্রস্ত ৫ লাখ শ্রমজীবী পরিবারের সদস্যদের কাছে খাবার পৌঁছে দেন তারা। এ ছাড়া চিকিৎসা সামগ্রী, চিকিৎসকদের পিপিই প্রদানও করছে সংগঠনটি। এ ছাড়াও চট্টগ্রামে গড়ে তুলেছেন করোনা হাসপাতাল। অসহায়দের পাশে আরো এগিয়ে এসেছে হিউম্যান ইফোর্টস ফর লোকাল পিপল (হেল্প), পে ইট ফরওয়ার্ড বাংলাদেশ, শিশুদের জন্য ফাউন্ডেশন, ডু সামথিং ফাউন্ডেশন, মজার স্কুল, একমুঠো চাল, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই এগিয়ে এসেছেন দুর্গতদের পাশে। করোনা দুর্গতদের ত্রাণ তহবিলে ১০ হাজার টাকা দান করেন একজন ভিক্ষুক।

আবার এই করোনার সময়টা নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে অনেকের জন্য। মিলি রহমান চাকরি করতেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দেশে করোনা আসার পর পরিবারের চাপে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর খুলে বসেন অনলাইন শপ। বলেন, আমি বাড়িতে বসে মাস্ক বানানো শুরু করি। এরপর তা বিক্রি করা শুরু করি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। দুই মাসে আমার আয় হয়েছে প্রায় লাখ টাকা।

করোনার প্রভাবে অনেক মানুষ বাড়িতে বন্দি। এই সময়টাতে তারা অধিক পরিমাণ সময় দিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তারকা খ্যাতি পেয়েছেন অনেকেই। ‘কিটো ভাই’ নামক ফেসবুক পেজ থেকে কিছু দিনের মাঝেই ছয় লাখের অধিক লাইক পায়। সুযোগ পান একটি মোবাইল কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও। এ ছাড়াও এই কারোনাকালে ছোট শিশু সুবহা সাফায়েত সিজদা‘সিজদা’ করোনা নিয়ে নানা পরামর্শ দিয়ে রীতিমতো পরিচিত মুখে পরিণত হয়েছে।

করোনাকালে দর্শক অধিক। তার প্রমাণ মেলে ইউটিউব চ্যানেল হালফিলের পরিচালক ফাহিম দেওয়ানের কথায়। তিনি বলেন, আগে যে কন্টেন্টের ভিডিও দিলে ১ হাজার ভিউ হতো এখন তা প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে। এমনকি ফেসবুক পেজেও এখন ভিউয়ার মিলছে অনেক।

আবার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেজেও আসছে পরিবর্তন। এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে তারা নিয়মিত করে যাচ্ছে ফেসবুক লাইভ। দেশের প্রতিষ্ঠিত অনেক গণমাধ্যম এই করোনাকালে ফেসবুক লাইভে যায়। এমনকি বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার তামিম ইকবাল খান পর্যন্ত লাইভে যান। সেখানে যুক্ত করেন দেশি-বিদেশি নানা ক্রিকেটারকে। আবার ক্রিকেটারদের বিভিন্ন ব্যবহার্য পণ্য করোনাকালে নিলামে তোলে ‘অকশন ফর অ্যাকশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অনলাইন এই নিলামে অর্জিত অর্থ করোনা দুর্গতদের সহযোগিতায় ব্যবহার করা হয়। এদিকে চিকিৎসককেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুলেছেন টেলিমেডিসিন সেবা। যার মাধ্যমে করোনাকালে অনেক রোগী মোবাইলের মাধ্যমে সেবা পাচ্ছেন।

এর পাশাপাশি করোনাকালে অনলাইন গরুর হাট সেবা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেক উদ্যোক্তা। বিভিন্ন শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন অনলাইন ক্লাস নিয়ে। আবার অযথা বাড়িভাড়া না দিতে ব্যবহার্য পণ্য রাখার প্লাটফর্ম রাখিবো ডটকম বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এই প্লাটফর্মের মাধ্যমে বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা তাদের পণ্য রেখে মেস ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে সাশ্রয়ী হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর