× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার , ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন ম্যালকম এক্স-এর চিঠি

দেশ বিদেশ


২১ জুলাই ২০২০, মঙ্গলবার

পূর্বে প্রকাশের পর
১৯৬২ সালে ম্যালকম বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়াবিদ বক্সার মুহাম্মদ আলীকে ‘নেশন’ এর সদস্য হতে সাহায্য করেন এবং তার আধ্যাত্মিক গুরুতে পরিণত হন।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং হার্ভার্ড ও অক্সফোর্ড এর মত বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। ম্যালকম এক্স তার বক্তৃতায় মূলধারার ‘সিভিল রাইটস মুভমেন্ট’ কে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতেন। এর পরিবর্তে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন। অহিংস নীতির বদলে তিনি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আত্মরক্ষার কথা বলতেন। ম্যালকম এক্স আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গী, প্রত্যয়দীপ্ত উচ্চারণ, বিদ্রুপ ও বিদগ্ধ রসের মিশ্রণ দিয়ে “ব্লাক ইজ বিউটিফুল” “ব্লাক প্রাইড” এর মত স্লোগানকে জনপ্রিয় করে তুলেন। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়াকে একটি গর্বের বিষয়ে পরিণত করেন। বলা যায়, তাঁর একক প্রচেষ্টাতেই আফ্রিকান-আমেরিকানরা ‘নিগ্রো’র বদলে কৃষ্ণাঙ্গ বা কালো বলে অভিহিত হতে শুরু করে।
ষাটের দশকের শুরুতে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬০ সালে আফ্রিকান দেশগুলোর আমন্ত্রনে বিশেষ অতিথি হিসেবে জাতিসংঘের অধিবেশনেও বক্তব্য রাখেন।

১৯৬৩ সালে নেশন ও ম্যালকম এক্স জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকাবস্থায় এলিজাহ মুহাম্মদ এর সাথে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। ম্যালকম এক্স কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদয়ে প্রতিবাদ ও মোকাবেলায় নেশন কে আরো সক্রিয় করতে চাইছিলেন। কিন্তু এলিজাহ এতে বাধ সাধেন। কিছুদিন পর একাধিক নারীর সাথে এলিজাহ এর অনৈতিক সম্পর্ক প্রকাশ হয়ে পড়লে ম্যালকম তার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।  ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হওয়ার পর এক বিতর্কিত মন্তব্যের অজুহাতে ম্যালকম এক্স কে ৯০ দিনের জন্য বক্তৃতা থেকে নিষিদ্ধ করে নেশন। ম্যালকম এতে দারুণভাবে আহত হন।  ১৯৬৪ সালের ৮ মার্চ প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নেশন ত্যাগ করেন। সম্পর্কচ্ছেদের পর এলিজাহ ম্যালকম এক্স এর বিরুদ্ধে হিংসাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। এমনকি একাধিকবার তাঁকে মৃত্যুর হুমকিও দেয়া হয়।
 
নেশন থেকে আলাদা হওয়ার সাথে সাথে ম্যালকম এক্স তাদের আদর্শ-বিশ্বাস থেকেও সরে আসেন। শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও আফ্রিকায় ফিরে যেত বলার পরিবর্তে সার্বজনীন কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি বর্ণবাদের সমস্যাকে একজন সমাজবিজ্ঞানীর চোখে দেখতে শুরু করেন। এসময় ‘মুসলিম মসজিদ ইনক.” নামে  একটি নতুন সংগঠনও গড়ে তুলেন। হজ্বের মওসুম এলে ম্যালকম এক্স হজ্ব করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেখানে তিনি এক নতুন জগতের সন্ধান পেলেন যা তার এতদিনের ধর্ম, বিশ্বাস, চিন্তা, আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গিকে আমূল পাল্টে দিল। তিনি অনুধাবন করলেন, তার এক যুগের সংগ্রামকে সাফল্যের দুয়ারে ভিড়াতে পারে কেবল ইসলামের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ।

হজ্ব পালন শেষে ম্যালকম এক্স আরব বিশ্ব ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তার আগে মক্কায় বসেই তাঁর অভিজ্ঞতা ও হৃদয়ের উপলব্ধি ব্যক্ত করে আমেরিকায় পরিবার ও সহকর্মীদের কাছে কয়েকটি চিঠি লেখেন। সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর জীবনবোধে পূর্ণ এসব চিঠি আমেরিকায় সাড়া ফেলে দেয়। তাঁর চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে ৮ মে ১৯৬৪ নিউ ইয়র্ক টাইমস “ম্যালকম প্লিজড বাই হোয়ইট’স এটিটিউড অন ট্রিপ টু মক্কা” (মক্কায় গিয়ে শ্বেতাঙ্গদের আচরণে মুগ্ধ ম্যালকম) শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। কী ছিল সেই চিঠিতে?

আলহাজ মালিক আল শাবাজ নামে ম্যালকম এক্স লিখেন,
জেদ্দায় এসে তিনি তৎকলীন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ (পরবর্তীতে বাদশাহ ফয়সাল) এর রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। ইবরাহিম (আ), মুহাম্মদ (স) এর স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ভূমিতে এসে তিনি অভূতপূর্ব ভালোবাসা ও আন্তরিকতায় সিক্ত হন। চারপাশের নানা বর্ণের মানুষের উদারতা ও বদান্যতা তাকে বাকরুদ্ধ ও হতবাক করে দেয়। তিনি সঙ্গীয় মুসলিমদের সাথে একই আল্লাহর ইবাদত করেছেন, এক প্লেটে খেয়েছেন, এক গ্লাসে পান করেছেন এবং এক বিছানায় ঘুমিয়েছেন; যাদের ছিল সবচেয়ে নীল চোখ, সবচেয়ে সোনালী চুল ও সর্বাধিক সাদা ত্বক। সেসকল শ্বেতাঙ্গ মুসলিমের কথা ও আচরণে তিনি নাইজেরিয়া বা সুদানের আফ্রিকান মুসলিমের মতই আন্তরিকতা অনুভব করেছেনে। কারণ মুসলিমরা আল্লাহর এককত্বের পাশাপাশি মানব পরিবারের এক হওয়াতেও বিশ্বাস করে। তাই মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে একজন মানুষ আর সাদা বা কালো থাকে না। একজন মুসলিমের যোগ্যতা ও গুরুত্ব বিচারে তার বর্ণের কোনো মূল্য থাকে না। তাঁর ভাষায় “আমরা ছিলাম প্রকৃতই ভাই ভাই- কেননা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তাদের মন, মানস ও আচরণ থেকে শ্বেত মনোভাব কে মুছে দিয়েছে।” তিনি কল্পনা করতে পারছিলেন না এমন অনেক ব্যক্তি তাঁর জন্য নিজের হোটেল রুম এমনকি বিছানা ছেড়ে দিবেন, যাদেরকে আমেরিকায় হয়ত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন শ্বেতাঙ্গ বলে অভিহিত করা হবে। তিনি কখনো এতটা সম্মানিত বোধ করেননি। তাঁর প্রতি প্রদর্শিত এমন সম্মান আমেরিকায় কেবল একজন রাজাই পেতে পারেন, কোনো ‘নিগ্রো’ নয়।

তিনি বুঝতে পারেন, যদি শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে প্রহণ করত, আল্লাহর একত্ববাদকে মেনে নিত; তাহলে তারা সাদা-কালো ভুলে মানব জাতির এককত্বের বাস্তবতাও মেনে নিতে পারত। নিছক বর্ণের ভিন্নতার কারণে কাউকে কষ্টও দিত না।

নীল চোখের স্বর্ণকেশী থেকে কালো চামড়ার আফ্রিকান; সকল বর্ণের লাখো হাজী সারা বিশ্ব থেকে এসে মক্কায় জড়ো হয়েছেন। সকল জাতি-বর্ণের মানুষ মিলে হজ্বের বিধানাবলী (তথা কাবা তওয়াফ, সাফা-মারওয়ায় সায়ী, মীনা-আরাফায় অবস্থান ইত্যাদি) পালন যেন তাদের অকৃত্রিম ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের চেতনার প্রদর্শনী। সত্যিকার ভ্রাতৃত্ববোধের এ এক বিস্ময়কর চেতনা। সাদা-কালোর ভেদাভেদ তাদেরকে পৃথক করার পরিবর্তে তাদের মধ্যকার বৈচিত্রকে ফুটিয়ে তুলছে। এটা এমন এক ব্যাপার যা আমেরিকায় অকল্পনীয়। এরকম অনেক দৃশ্য ও অভিজ্ঞতা ম্যালকম এক্স এর পূর্বতন চিন্তা ও দর্শনকে পাল্টে দেয়। তিনি সম্পূর্ণরূপে নেশন অব ইসলাম এর মতাদর্শ ছেড়ে চিরায়ত ইসলামী (সুন্নী) আদর্শকে গ্রহণ করেন।

ম্যালকম এক্স তাঁর চিঠিতে আমেরিকান সমাজের করণীয়ও বাতলে দেন। তাঁর মতে, “আমেরিকার ইসলাম বুঝা দরকার। কেননা এটা এমন এক ধর্ম যা সমাজ থেকে বর্ণের সমস্যা মুছে ফেলে।” ইসলাম যেভাবে মুসলিম বিশ্বের মানস থেকে শ্বেত মনোভাব ঘুচিয়ে দিয়েছে, একইভাবে তা সত্যিকার ভ্রাতৃত্ববোধ দিয়ে আমেরিকান মানসকেও পাল্টে দিতে পারে। তাই “বর্ণবাদ যখন আমেরিকাকে দুরারোগ্য ক্যান্সারের মত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, তখন ‘খ্রিস্টান’ শ্বেত আমেরিকান হৃদয়ের উচিত ধ্বংসাত্মক সমস্যার এই প্রমাণিত সমাধানের প্রতি অধিকতর আগ্রহী হওয়া।” হয়ত এটা আমেরিকাকে সেরকম আসন্ন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে; যেরকমভাবে জার্মানির বর্ণবাদ জার্মানদেরকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল।

ম্যালকম এক্স আশংকা করেন, “বর্ণবাদী উন্মত্ততা আমেরিকাকে এক আত্মঘাতী পথে নামিয়ে দিয়েছে।” তবে তাঁর বিশ্বাস, “আমেরিকাকে এ অনিবার্য বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে কলেজ-ভার্সিটির তরুণ প্রজন্মের শ্বেতাঙ্গদের অনেকেই পরিত্রানের একমাত্র উপায় হিসেবে সত্যের এই আধ্যাত্মিক পথেই ফিরে যাবে।”

হজ্ব থেকে ফিরে ম্যালকম এক্স ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের আলোকে তার সংগ্র্রাম নতুনভাবে শুরু করেন। ইসলামের এই প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধের প্রচার নেশনকে শংকিত করে তুলে। তাদের শ্বেতাঙ্গ বিদ্বেষী বিচ্ছিন্নতাবাদী আদর্শ হুমকির মুখে পড়ে যায়। তারা ক্রমাগত ম্যালকম এক্স কে হত্যার হুমকি দিতে থাকে। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী নেশনের পাঠানো আততায়ীর গুলিতে শহীদ হন ম্যালকম এক্স। জীবন দিয়েই ম্যালকম এক্স তাঁর বিশ্বাসের মূল্য দিয়ে গেলেন।

ম্যালকম এক্স এর মৃত্যুর পর ৫৫ বছর গত হয়েছে। কিন্তু বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর আহ্বান আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম মৃত্যু সেটা আরও একবার আমেরিকানদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেল।      (শেষ)
মোহাম্মদ শিশির মনির
এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
সঙ্গে
 মোনায়েম খান
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর