কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় মামলা করেছেন তার বোন শারমিন শাহরিয়া। গতকাল এডভোকেট মো. মোস্তফার নেতৃত্বে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহার আদালতে মামলাটি দাখিল করেন শারমিন শাহরিয়া। মামলায় আসামি করা হয়েছে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৯ জনকে। বিচারক তামান্না ফারাহ মামলার তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন র্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের অধিনায়ককে। তদন্ত কর্মকর্তাকে মামলার তদন্ত করে আদালতকে জানানোর কথা বলেছেন বিচারক। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন অফিসের সামনে পৌঁছান মেজর সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া। সেখানে এডভোকেট মো. মোস্তফার চেম্বারে অবস্থান করে মামলার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। আদালত প্রাঙ্গণে শারমিন শাহরিয়া ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তাদের আইনজীবী ও কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী মোহাম্মদ মোস্তফা ও হাইকোর্টের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির।
মোহাম্মদ মোস্তফা সাংবাদিকদের বলেছেন, মামলার এজাহার টেকনাফ থানায় পৌঁছানো হবে। আর শারমিন শাহরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমার ভাই মারা গেছেন ৩১শে জুলাই রাতে। টেকনাফ থানা থেকে আমাদের বলা হয়নি, আমাদের ভাই মারা গেছে। পরদিন সকালে আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছে। তারাও বলেনি, আমার ভাই মারা গেছে। আমরা চাচ্ছি, আমার ভাই হত্যার বিচার দ্রুত কার্যকর করতে। এজন্য আদালতে মামলা করেছি।
এজাহারসূত্রে জানা গেছে, মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার দাশকে। এ ছাড়া মামলার অপর আসামিরা হলেন, টেকনাফ থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা। মামলায় প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। এর বাইরে আরো ৯ জন সাক্ষীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে সিনহার বোন উল্লেখ করেছেন, ৩১শে জুলাই বিকালে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিও চিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এই পোশাক তিনি পরেছিলেন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রাত ৮টা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তারা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শামলাপুর তল্লাশি চৌকিতে পৌঁছালে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত উপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন। একপর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত উপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ্য করে গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু’ এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব পরিকল্পিতভাবে সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন। এ সময় সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরেকটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়া থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃত্যু নিশ্চিত হন। এ ছাড়া বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষীদের ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।