× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার , ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

সর্বশেষ ক্রসফায়ার

মত-মতান্তর

রফিকুর রহমান
৯ আগস্ট ২০২০, রবিবার

বিগত ৭ই আগস্ট দৈনিক মানবজমিনে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের( আইএসপিআর) বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে একটা সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে।
সংবাদটির শিরোনাম ছিল ‘পুলিশের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে এটাই শেষ ঘটনা‘। সংবাদটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
সম্প্রতি পুলিশের কতিপয় সদস্য দ্বারা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ডকে সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড বলে পুলিশের আইজিপি যে আশ্বস্ত করেছেন সেটা সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত সদস্যের হত্যাকাণ্ডের বেলায় কথিত হলেও আমাদের বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে নিরাপত্তার যে আশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে তা জাতির সর্বপর্যায়ের প্রতিটি মানুষের জন্যই প্রযোজ্য হবে। দেশজুড়ে সরকারের অনেক ব্যর্থতার মাঝেও একটি আশার আলো প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে অন্তত কাউকে বিনাবিচারে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যার শিকার হতে হবে না। আইজিপি নিঃসন্দেহে তার
বক্তব্যের জন্য সাধুবাদ পেতে পারেন। আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে তার এই নির্দেশনার কার্যকারিতা উপলব্ধি করার জন্য।

কোন কোন মৃত্যু সময়ে সময়ে এতই ভারী হয়ে যায় যে এটা সমাজের অনেক অপসংস্কারকে আমূল পরিবর্তন করতে সাহায্য করে। আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে মেজর সিনহার মৃত্যু পর্যন্ত যাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অপসংস্কৃতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারি। আইজিপির বক্তব্যে আমরা আশাবাদী।

মেজর সিনহা ছিলেন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত একজন চৌকস সেনা কর্মকর্তা।
কতিপয় পুলিশ সদস্য তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে টেকনাফের সন্নিকটে মেরিন ড্রাইভের একটি চেকপোষ্টে। ঘাতকরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, প্রাণহীন দেহটি তাদের পৈশাচিক ও অমানবিক আচরণ থেকেও রক্ষা পায়নি যা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসেছে। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরই কেবল তাকে হাসপাতলে পাঠানো হয় । এই বর্বরতা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অনেক বর্বরতাকেও হার মানায়। এই বর্বরতা সভ্য জগতে জাতি হিসেবে আমাদের সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

এই হত্যাকাণ্ডকে আইনি করণ করার জন্য গতানুগতিক পুরানোপন্থা অনুসরণ করে সাজানো হয় নানাবিধ মিথ্যা গল্প এবং থানায় রুজু করা হয় মিথ্যা মামলা। এরকম বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা সভ্যজগতে প্রায় অনুপস্থিত। এটা মানা যায়না। আমাদের মত জাতির জন্য এটা লজ্জাজনক অন্তত যে জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে সাম্য,মানবিক মূল্যবোধ এবং সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষে।

বিচারবহির্ভূত আরেকটি হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করা এখানে খুবই প্রাসঙ্গিক। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ঘটনাটি ২০১৮ সালের মে মাসের কোন এক তারিখে। একরামুল হক নামের টেকনাফের এক ওয়ার্ড কমিশনারকে কিভাবে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয় তা আমরা কমবেশি সকলেই জানি। সেখানেও সাজানো হয় বন্দুকযুদ্ধের নাটক। হত্যার প্রাক্কালের একটি অডিও ক্লিপ সর্বত্র ভাইরাল হয়ে যায় যা থেকে অনুমান করা যায় কি নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। তার স্ত্রী সাংবাদিক সম্মেলন করে একটি বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেছিলেন তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। উনি এই হত্যাকান্ডের বিচার চেয়েছিলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করে বলেছিলেন ঘটনার তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে। পরবর্তী পর্যায়ে দৃশ্যত আমরা এর কোনো অগ্রগতি দেখিনি। একরামুল হক রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন বাহিনীর সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন ওয়ার্ড কমিশনার হিসেবে একজন সমাজসেবক। রাষ্ট্রকে আমরা সে সময় শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখিনি। এটা ছিল দুঃখজনক। রাষ্ট্র হবে সকল পর্যায়ের সকল নাগরিকদের জন্য সমান রক্ষাকবচ এবং এটাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এটাই আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের মূল ভিত্তি (বাংলাদেশের সংবিধান, মৌলিক অধিকার, অনুচ্ছেদ ২৭)। সে সময় আজকের মত এরকম একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা গ্রহনের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করলে হয়তো আমরা মেজর সিনহার হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে যেতে পারতাম।

গত দশকের প্রথম দিক থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যার যে অপসংস্কৃতি শুরু হয় তা প্রথমে একটি বিশেষ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত এবং তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পর্যায়ক্রমে তা পুলিশের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে এক ভীতিকর অবস্থার সৃস্টি করে।

সরকার পরিবর্তন হলেও এই হত্যাকান্ডের কালচারের কোন পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান সরকার প্রধান বিরোধী দলে থাকাকালীন অবস্থায় হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও সরকারে এসে তাঁর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এটা একটা বিশাল ব্যর্থতা। সাম্প্রতিককালে সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানে এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মহোৎসব শুরু হয় যার সর্বশেষ শিকার মেজর সিনহা।

আজকে আমাদের প্রয়োজন আমজনতার জনবান্ধব নেতৃত্ব , আমাদের দরকার আমজনতার সেই নেতৃত্ব যে নির্দেশ দিতে পারবে আর যেন কোন ক্রসফায়ারের নামে কাউকে নিহত হতে না হয় । যত বড় অপরাধীই হোক তাকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত বিচার ব্যবস্থার আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, কোন হত্যাকাণ্ডের নাটকের মাধ্যমে নয় ।এই ন্যূনতম অধিকার থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে এটাই আমাদের কাম্য। আমরা স্বাধীন হয়েছি সভ্য জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। বর্বর জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করার জন্য নয়।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা নামক বই দুটো পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বিচার বহির্ভূত হত্যার সাথে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সাংঘর্ষিক এবং তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। এই বর্বরতা ফ্যাসিবাদের পরিচয় ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি এখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ।আপনার সুনির্দিষ্ট আদেশের মাধ্যমে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ হবে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল বাহিনী সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা নিয়ে দায়িত্ব পালন করবে, এমনটাই আশা করি।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর