× প্রচ্ছদ অনলাইনপ্রথম পাতাশেষের পাতাখেলাবিনোদনএক্সক্লুসিভভারতবিশ্বজমিনবাংলারজমিনদেশ বিদেশশিক্ষাঙ্গনরকমারিমত-মতান্তরবই থেকে নেয়া তথ্য প্রযুক্তি শরীর ও মন চলতে ফিরতে কলকাতা কথকতাসেরা চিঠিইতিহাস থেকেঅর্থনীতি
ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার , ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৬ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মিঠে-কড়া ভারত-বাংলাদেশ: সম্পর্ক বরাবরই ওঠানামা করে

অনলাইন

সাহাব এনাম খান
(৩ বছর আগে) সেপ্টেম্বর ২০, ২০২০, রবিবার, ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দীর্ঘদিন হয়ে গেল আন্তর্জাতিক চর্চার বিষয়। বিশেষ করে পূর্ব লাদাখে ভারত-চীন সংঘাতের প্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দু’টি দেশের সম্পর্ককে নতুন আলোয় দেখা শুরু হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় ভারতীয় মিডিয়া এই দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক নিয়ে কখনো উদাসীন, কখনো এমন তথ্য দিতে ব্যস্ত যা বাস্তবতা থেকে বহুদূরে। অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। এর ফলে দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা যে খুব ইতিবাচক তা বলা যাবে না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত যেভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, বাংলাদেশ কখনো ভোলেনি। কিন্তু, এটাও মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দিল্লির একটি প্রচ্ছন্ন তাগিদ ছিল বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর। এই সম্পর্ক ক্রমশ নিবিড় হয়, বিশেষ করে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তদানীন্তন ইউপিএ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের নিরিখে বাংলাদেশ আরো কাছে আসে ভারতের। রাজনীতিতে বলা হয়ে থাকে প্রতিবেশী দেশে ক্ষমতা বদল হলেও পরম্পরা থেকে যায়।

বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতায় এলেও ২০১৫ সালে ছিটমহল সংক্রান্ত সীমান্ত সংলগ্ন জমি হস্তান্তর চুক্তিটি মোদি সরকারের সদর্থক আচরণেরই ফল। তবে এটাও সত্য যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংসদ সীমান্ত চুক্তি ১৯৭৪ সালে অনুমোদন করলেও ভারতের ক্ষেত্রে তা অনুমোদনের জন্য দীর্ঘ চার দশক সময় প্রয়োজন হয়। কিন্তু, এরপরই এনডিএ সরকার সিএএ এবং বিশেষ করে আসামে এনআরসি আইন বলবৎ করে। যদিও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি আইন দু’টিকে বাংলাদেশ বরাবরই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উল্লেখ করে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাধারণ নাগরিক মহল মনে করে এই দু’টি আইন বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী এবং এর ফলে বাংলাদেশ নতুন করে উদ্বাস্তু-সমস্যার সামনে পড়তে পারে। বাংলাদেশকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমানা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক আইনের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।
ভারতের সংশোধিত নাগিরকত্ব আইন (সিএএ)-র সেকশন ২, সাব-সেকশন ১ এবং ৩ এ- এ বাংলাদেশকে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে একাসনে বসানোকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। রাখাইন চুক্তি এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক নিয়ে ভারতের নীরবতা বাংলাদেশের আবেগকে ব্যথিত করেছে। বিমসটেক ও সার্কের ক্ষেত্রে ভারতের ধীরে চলার নীতি, কিংবা নেপাল ও ভুটান থেকে আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের এনার্জি করিডোর তৈরির প্রয়াসের ক্ষেত্রে অসহযোগিতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সার্ক পুনরুজ্জীবনের জন্য নরেন্দ্র মোদির নিরন্তর প্রয়াসকে স্বীকৃতি দেয়। বাণিজ্যিকভাবে ভারত-বাংলাদেশের অবস্থান মজবুত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং রাজনৈতিক সম্পর্কের ওঠা-পড়া দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারেনি।
ভারত ২০১৮-১৯ সালে আট বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশে এবং বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে ১ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার পণ্য। বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় অভিবাসীদের রেমিট্যান্স প্রায় চার বিলিয়ন ডলার বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে । বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় ইকোনমিক জোন তৈরির জন্য ১১০৬ একর জমি বরাদ্দ দিয়েছে । সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় বিষয়টি করোনাকালীন সময়ে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন জানান যে, ভারত আগাম ঘোষণা না দিয়ে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ করায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুতপ্ত হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা নুতন কিছু নয় বলে আমরা জানি।

কিন্তু তথ্যাভিজ্ঞ মহলের মতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দুই দেশ বাণিজ্যিক কারণেই সম্পর্কে সুস্থিতি রাখতে আগ্রহী হবে। কিন্তু আবার প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা দু’দেশের সম্পর্কে কিছুটা শিথিলতা এনেছে। খুলনা-মোংলা পোর্ট রেললাইন বসানোর কাজে ভারত-বাংলাদেশ মৌ স্বাক্ষরিত হয় ২০১০ সালে। আর্থিক তহবিলের সুষম বণ্টনের ভারতীয় অবহেলার কারণে প্রকল্পটির কাজ দশ বছরে আর্থিকভাবে তেষট্টি শতাংশ এগিয়েছে, ফিজিক্যাল অগ্রগতি ৬১.৯০ শতাংশ। ভারত বাংলাদেশকে ৮ বিলিয়ন ডলার লাইন অফ ক্রেডিট, যা সাদা কথায় সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যার বেশিরভাগই ছাড় হয়নি। বাংলাদেশের কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ঋণ জালের সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
ভূকৌশলগত ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক শক্ত পটভূমিতেও দাঁড়ালেও মিয়ানমার সম্পর্কে ভারতীয় নীতি বাংলাদেশের ভ্রু’কুঞ্চিত করেছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক বা রাডার ক্রয় নিয়ে সমঝোতা থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারকে ভারত সম্প্রতি যে সাবমেরিন সরবরাহ করেছে তা বাংলাদেশ এর আবেগকে আহত করার পক্ষে যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী মোদির মিয়ানমার সফরে গিয়ে রাখাইন সম্পর্কিত উক্তিও বাংলাদেশ ভালোভাবে নিতে পারেনি। রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে ভারতের নীরবতা এবং চীনের প্রো-আক্টিভ মানসিকতা বাংলাদেশ গভীরভাবে অনুধাবন করেছে।
ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকাও এখানে সমালোচনার যোগ্য। তারা চীনের বাংলাদেশকে দেয়া দু’টি সাবমেরিনের কথা ফলাও করে প্রচার করলো, কিন্তু ভারতের কাছেও বাংলাদেশ সাবমেরিন বিষয়ক সহায়তা চেয়েছিল সেই বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম বাংলাদেশ চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং যৌক্তিকভাবে চীন থেকে প্রাপ্ত শুল্কমুক্ত সুবিধার বিষয়টিকে হেয় ভাবে দেখা হচ্ছে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের পুনর্মূল্যায়ন হওয়া উচিত যা দু’দেশকেই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে। আরো মনে রাখা দরকার যে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহ দমনে একমাত্র বাংলাদেশেই ভূমিকা রেখেছে।
লকডাউন এর সময় বাংলাদেশের ক্রেতাদের অনুপস্থিতিতে কলকাতায় ব্যবসা বাণিজ্যে ধস নেমেছে। মার খেয়েছে হেলথ সেক্টরও। বাংলাদেশও উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এটা মনে রাখা দরকার যে ভারতের প্রতি পাঁচজন পর্যটকের একজন হলো বাংলাদেশী। এর ফলে জাতীয় আয়ের নিরিখে ভারতের অর্থনীতিতে বাংলাদেশি পর্যটকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্যের মূল অংশই আসে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত থেকে, ফলে বাংলাদেশের জন্য ভারত যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি চীন ও যুক্তরাষ্ট্র অবিচ্ছেদ। বাংলাদেশ-চীনা সম্পর্কের সুফল পরোক্ষভাবে ভারত পেয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতেও পেয়ে থাকবে।
অর্থিনীতির প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে সরকারের একটি মৌলিক দায়িত্ব এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের নিশ্চয়তায় বাংলাদেশ সরকার যা করণীয় তাই করবে বলেই জনগণ আশা করে। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার একটি মৌলিক উপাদান হলো পানিসম্পদ যা রক্ষায় বাংলাদেশ বৈজ্ঞানিক ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। ফলে তিস্তার জন্য ভারত নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসাটা দুই দেশের জন্যই লাভজনক হবে বলে মনে হয়।
এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই বাংলাদেশ ১৯৭১ কিংবা ২০০৯ সালে আটকে নেই। স্বাধীন এবং স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাত্রা তার অনেক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভালো। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জীবনের মানোন্নয়নে বাংলাদেশের সফলতা দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের তুলনায় সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে আছে। তাই বাংলাদেশ ভারতের সুসম্পর্ককে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি পুনর্ন্মর্ািণ করা উচিত হবে। এর জন্য এই প্রতিবেশী দুই বন্ধু রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাতে দু’দেশেরই মঙ্গল।


[লেখক: জাহাঙ্গীরনগর  বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক। ইউরো এশিয়া রিভিউতে প্রকাশিত লেখার অনুবাদ]
অবশ্যই দিতে হবে *
অবশ্যই দিতে হবে *
অন্যান্য খবর